শঙ্করাচার্য ৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই বৈশাখ শুক্লাপঞ্চমী
তিথিতে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে কেরল দেশের মালবার প্রদেশের কালাডি গ্রামের
নম্বুরি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শিবগুরু এবং মাতার নাম
বিশিষ্টা দেবী। ভগবান শঙ্করের বরেই শঙ্করের জন্ম বলে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল শঙ্কর।
শঙ্করের বয়স তিন বৎসর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। শিশুকাল থেকেই
শঙ্কর ছিলেন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন শ্রুতিধর অর্থাৎ সবকিছু শুনেই
আত্মস্থ করতে পারতেন। তিনি পাঁচ বছর বয়সে বেদ অধ্যয়নের জন্য উপনয়ন দিয়ে গুরুগৃহে
গমন করেন।
দুই বৎসরের মধ্যে অর্থাৎ সাত বৎসর বয়সেই বেদ-বেদাঙ্গ পাঠ
সমাপ্ত করে ফেলেন। শঙ্করের মাতা বিশিষ্ট দেবী গৃহ থেকে বেশ দূরে আলোয়াই নদীতে
স্নান করতে যেতেন। একদিন স্নান করে গৃহে ফেরার পথে বিশিষ্ট দেবী ক্লান্তিবশত
মুর্ছিতা হয়ে পড়লেন। শঙ্কর মাকে সেবা-শুশ্রূষার দ্বারা সুস্থ করে তুললেন এবং মাকে
যাতে দূরে গিয়ে স্নান করতে না হয়, সেজন্য আলোয়াই নদীকে তাঁদের গৃহের নিকট হতে
প্রবাহিত হওয়ার অনুরোধ জানালেন। তারপর থেকে আলোয়াই নদী তাঁদের গৃহের নিকট হতে
প্রবাহিত হতে থাকল। সত্যি এরকম মাতৃভক্তি জগতে বিরল।
একদল জ্যোতিষী শঙ্করের কোষ্ঠী বিচার করে দেখলেন যে,
শঙ্করের আয়ু মাত্র আট বৎসর তবে তপস্যা প্রভাবে আরও আট বৎসর বর্ধিত হতে পারে। একথা
শুনে শঙ্করের মনে সন্ন্যাস নেয়ার ইচ্ছা জাগল। কিন্তু মাতা তাঁকে সন্ন্যাস গ্রহণ
করার অনুমতি দিলেন না। একদিন শঙ্কর আলোয়াই নদীতে স্নান করার সময় একটা কুমির তাঁকে
ধরে গভীর জলে নিয়ে যেতে লাগল। মাতা তাঁকে রক্ষা করতে ছুটে আসলে ‘‘মা, সন্ন্যাসের
অনুমতি দাও’’ বলে শঙ্কর চিৎকার শুরু করলেন। মাতা তখন সন্ন্যাসের অনুমতি দেওয়ার
সাথে সাথে কুমির শঙ্করকে ছেড়ে দিল। এভাবে শঙ্কর অলৌকিক উপায়ে মাতার নিকট
সন্ন্যাসের অনুমতি নিয়ে গৃহত্যাগ করলেন। তবে যাওয়ার আগে তিনটি প্রতিজ্ঞা করে
গেলেন। প্রতিজ্ঞা তিনটি এরকম- তিনি মায়ের মৃত্যুকালে তাঁকে দর্শন দিবেন, মায়ের
মৃত্যুকালে তাঁকে ভগবান দর্শন করাবেন এবং তিনি নিজে মায়ের সৎকার করবেন।
শঙ্কর গৃহত্যাগ করে নর্মদা-তীরে এসে গোবিন্দপাদ নামক এক
সিদ্ধ-পুরুষের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শঙ্করাচার্য গুরুর নির্দেশে বেদান্ত প্রচারের
জন্য কাশীধাম গমন করেন। পরে সেখান থেকে বদরিকা আশ্রমে এসে গুরুর নির্দেশমত উপনিষদ,
ব্রহ্মসূত্র ও গীতার ভাষ্য রচনা করেন। শঙ্করের বয়স ষোল বৎসর পূর্ণ হলে মহর্ষী
ব্যাসদেব এসে তাঁর আয়ু আরও ষোল বৎসর বর্ধিত করে যান।
শঙ্কর বেদান্ত প্রচারের নিমিত্ত সশিষ্য ভারতের বিভিন্ন
স্থান ভ্রমণ করেন এবং বিভিন স্থানের পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে বেদামন্ত
দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। তিনি আকাশ-পথে উড়ে এসে মীমাংসাকার কুমারিল ভট্টের
শিষ্য মণ্ডনকে তর্কশাস্ত্রে পরাজিত করেন। একদিন শঙ্করের পাণ্ডিত্ব্যে ইর্ষান্বিত
হয়ে উগ্রভৈরব, ক্রবাচ প্রভৃতি কাপালিকরা তাঁকে হত্যা করতে এসে অলৌকিক উপায়ে উল্টো
নিজেরাই নিহত হন।
শঙ্করাচার্য একদিন সূক্ষ্মদেহে অমরুক নামক রাজার মধ্যে
প্রবেশ করে স্ত্রী সম্বন্ধে অনেক বিষয় শিক্ষা অর্জন করে একটি স্ত্রী-চরিত্র
সম্বন্ধীয় গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি মাতা বিশিষ্টা দেবীর মৃত্যুর পূর্বকালে শূন্যপথে
মায়ের নিকট উপস্থিত হয়ে পূর্বের তিনটি প্রতীজ্ঞা পালন করেন। শঙ্করাচার্য কাশী,
কাঞ্চী, কর্ণাট, কামরূপ প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করে বেদান্ত মত প্রচার করেছিলেন।
জীবনের শেষদিকে তিনি কাশ্মীর গমন করেন। সেখানের প্রচারকার্য শেষ হলে বদরিকাশ্রমে
চলে যান এবং শিষ্যদের তাঁর প্রতিষ্ঠিত মঠে গিয়ে প্রচারকার্য করার নির্দেশ দেন।
কিন্তু শিষ্যরা গুরুসঙ্গ ত্যাগ করতে সম্মত না হওয়ায় তাঁদের সঙ্গে কিছুদিন হিমালয়ের
কেদারধামে বাস করেন। তারপর সেখানে তাঁর বয়স বত্রিশ বৎসর পূর্ণ হলে মহাসমাধি যোগে
তিনি দেহত্যাগ করেন।
কোন মন্তব্য নেই