বৈষ্ণব সাধক
রামানুজ
রামানুজ কেশব ত্রিপাঠীর ঔরসে ভূমিদেবীর গর্ভে মাদ্রাজের পেরুম্বুর নামক
স্থানে ১০১৭ মতান্তরে ১০৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কাঞ্চীপুরে শিক্ষা লাভ করেন
এবং কাবেরী নদীর দুই শাখার মধ্যবর্তী শ্রীরঙ্গদ্বীপে শ্রীরঙ্গনাথের উপাসনা করেন।
শ্রীরঙ্গধামে বসে তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ভারতবর্ষের নানা স্থানের
নানা পণ্ডিতদের তর্কবিচারে পরাজিত করেন। ব্যঙ্কট-গিরি নামক স্থানে তিনি
বিষ্ণু-মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কর্ণাটে বেতালদেব নামক এক রাজা ছিলেন। রাজা
বেতালদেব ছিলেন জৈন ধর্মের উপাসক। রামানুজ রাজা বেতালদেবের কন্যাকে দুরারোগ্য
ব্যাধি থেকে মুক্ত করায় রাজা রামানুজের নিকট বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তারপর
তিনি কাঞ্চীপুর, মহারাষ্ট্র, দ্বারকা প্রভৃতি স্থানে বৈষ্ণব মত প্রচার করেন। পরে
তিনি বারাণসী, প্রয়াগ, হরিদ্বার প্রভৃতি তীর্থ ভ্রমণ করেন। রামানুজ ১০৫৭ মতান্তরে
১০৭৭ সালে ৪০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
মাধ্বাচার্য
মাধ্বী সম্প্রদায়ের প্রবর্তক মাধ্বাচার্য দক্ষিণাপথে ১১২১ শকাব্দে
জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মধিজী ভট্ট। কথিত আছে মহর্ষি ব্যাসদেব তাঁকে তিনটি
শালগ্রাম শিলা উপহার দেন এবং তিনি সুব্রহ্মণ্য,
উদিপি ও মধ্যতল নামক স্থানের তিনটি মঠে ঐ শালগ্রাম শিলা প্রতিষ্ঠিত করেন। এর মধ্যে
উদিপি নগর মধ্বচারীদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র। এছাড়াও তিনি আটটি মন্দির নির্মাণ
করেন। সেই আটটি মন্দিরে তিনি রাম-সীতা, লক্ষ্মণ ও সীতা, দ্বিভূজ, কালীয়মর্দন,
চতুর্ভূজ, সুবিতল, সুকর, নৃসিংহ এবং বসমত্ম-বিতল এই আট প্রকার মূর্তি স্থাপন করেন।
মধ্বাচার্য উদীপী মঠে বসে দশোপনিষদ ভাষ্য, ব্রহ্মসূত্র
ভাষ্য, অনুবাকানুনয়বিবর্ণ, অনুবেদান্তরস প্রকরণ, ভারত-তাৎপর্য নির্ণয়,
ভাগবত-তাৎপর্য, গীতা-তাৎপর্য, কৃষ্ণামৃত মহার্ণব তন্ত্রসার প্রভৃতি ৩৬ খানা গ্রন্থ
রচনা করেন।
জয়দেব
বীরভূমের প্রায় দশ ক্রোশ দক্ষিণে অজয় নদের তীরে কেন্দুলি গ্রামে জয়দেবের
জন্ম। জয়দেব প্রথম জীবনে সন্ন্যাসী ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে পদ্মাবতী নামক এক ব্রহ্মণকন্যার পাণি গ্রহণ করেন।
গার্হস্থ্য আশ্রমে প্রবেশের পর তিনি ‘‘গীতগোবিন্দ’’ নামক একখানা গ্রন্থ রচনা
করেছিলেন। কথিত আছে যে, নীলাচলের রাজাও ‘‘গীতগোবিন্দ’’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা
করেছিলেন। দুইটি গ্রন্থই জগন্নাথদেবের সামনে রাখা হলে জগন্নাথদেব জয়দেবের গ্রন্থ
বক্ষে ধারণ করলেন এবং ঐ রাজার গ্রন্থ মন্দিরের বাইরে নিক্ষেপ করলেন। এভাবে জয়দেবের
‘‘গীতগোবিন্দ’’ অমর হয়ে থাকল।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ ১৪৮৬ খৃষ্টাব্দে (১৪০৭ শকাব্দে) ফাল্গুন মাসের
পূর্ণিমায় নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতার নাম
শচীদেবী। জগন্নাথ মিশ্র পূর্বে শ্রীহট্টে বাস করতেন। পরে তিনি গঙ্গাবাসের
উদ্দেশ্যে নবদ্বীপে বাস করা শুরম্ন করেন। অল্প বয়সেই চৈতন্যদেব পিতাকে হারান। তাঁর
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিশ্বরূপ পিতার মৃত্যুর পূর্বেই সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন।
শ্রীচৈতন্যবাল্যে নিমাই নামে পরিচিত ছিলেন। নিমাই
গঙ্গাদাস পণ্ডিতের পাঠশালায় কৃষ্ণানন্দ, কমলাকান্ত, মুরারী গুপ্ত প্রভৃতি
সহপাঠীদের সাথে শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি নবদ্বীপের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ বল্লভাচার্যের
মেয়ে লক্ষ্মীদেবীকে বিয়ে করেন। তিনি বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তির জোড়ে ক্রমান্বয়ে
নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হয়ে ওঠেন এবং নবদ্বীপে অধ্যাপনা শুরু করেন। নিমাই পিতা
জগন্নাথ মিশ্রের পিতৃভূমি পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্ট (বর্তমান সিলেট) ভ্রমণকালে তাঁর
স্ত্রী সর্পদংশনে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর তাঁকে রাজপণ্ডিত সনাতনের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার
সাথে বিবাহ দেয়া হয়। গয়ায় পিতৃদেবের পিণ্ড দিতে গিয়ে মাধবেন্দ্রপুরির শিষ্য
ঈশ্বরপুরির নিকট দীক্ষাগ্রহণ করে ফিরে আসেন। দীক্ষাগ্রহণের পর থেকে নিমাইয়ের অনেক
পরবর্তন লক্ষ্য করা গেল। ধীরে ধীরে নিমাই টোলের অধ্যাপক থেকে কৃষ্ণপ্রেমীক হতে
শুরু করলেন। ২৪ বছর বয়সে নিমাই মাতা ও
স্ত্রীকে ত্যাগ করে কাঠোয়াতে এসে সন্ন্যাসী কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।
তখন তার নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। সন্নাস নেয়ার পর চৈতন্যদেব একবার নবদ্বীপের কাছে
শান্তিপুরে অদ্বৈতের বাড়িতে এসেছিলেন। সেখানে তিনি মাতা শচীদেবীর সাথে সাক্ষাৎ
করেন। কিন্তু সন্ন্যাসীদের স্ত্রী-সাক্ষৎ নিষিদ্ধ বলে বিষ্ণুপ্রিয়া চৈতন্যদেবকে
দর্শন করতে পারেন নি। শান্তিপুর থেকে চৈতন্যদেব পুরীতে গমন করেন। পরেও আরেক বার
তিনি নবদ্বীপে এসে মায়ের সাথে দেখা করেছিলেন এবং তখন বিষ্ণুপ্রিয়াকে পাদুকা দান
করেছিলেন। এরপর তিনি বৃন্দাবন, প্রয়াগ, কাশী প্রভৃতি তীর্থ ভ্রমণ করেন। নিত্যানন্দ,
অদ্বৈত, গদাধর, শ্রীনিবাস, রামানন্দ, হরিদাস, পভৃতি বৈষ্ণবগণ ছিল তাঁর প্রধান
পার্শ্বদ। এদের মধ্যে অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে চৈতন্যের দুই অঙ্গ স্বরূপ কল্পনা করা
হয়। নিত্যানন্দ চৈতন্যের খুবই প্রিয়ভাজন ছিলেন। নিত্যানন্দ একবার জগাই ও মাধাই
নামক নদীয়ার দুই পাপিষ্ঠ ব্রাহ্মণকুমারকে উদ্ধার করতে চাইলেন। সে লক্ষ্যে তিনি
অনেক ভক্তদের সাথে নিয়ে নাম-কীর্তন করতে করতে জগাই-মাধাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা
হলেন। জগাই-মাধাই মদ পান করে ঘুমাচ্ছিলেন। নাম-কীর্তন শুনে তাদের ঘুম ভাঙায় তারা
খুব বিরক্ত হলেন। নিত্যানন্দ বারংবার তাদেরতে হরিনাম করার অনুরোধ করলেন। মাধাই তখন
ক্রোধান্বিত হয়ে নিকটস্থ একটি ভাঙ্গা কলসির টুকরা দ্বারা নিত্যানন্দকে আঘাত করল।
ফলে নিত্যানন্দের কপাল কেটে রক্ত ঝরতে লাগল। চৈতন্যদেব খবর পেয়ে ঐ স্থানে ছুটে
আসলেন। তিনি জগাই-মাধাই শাস্তি দেয়ার জন্য সুদর্শন চক্রকে স্মরণ করলেন। কিন্তু
নিত্যানন্দ তাঁকে নিরস্ত করলেন। শত্রু কর্তৃক আঘাত পেয়েও শত্রুকে ক্ষমা করার মত উদারতা আর কি হতে পারে?
নিত্যানন্দের উদারতা ও মহত্ব দেখে জগাই-মাধাইয়ের বোধোদয় হয়। অবশেষে গৌর-নিতাইয়ের
পরশে জগাই-মাধাই শুদ্ধ বৈষ্ণবভক্তে পরিণত হয়। বৈষ্ণবদের মতে শ্রীচৈতন্য রাধা ও
কৃষ্ণের মিলিত রূপ, নিত্যানন্দ বলরাম, অদ্বৈত সদাশিব, শচীদেবী যশোদা এবং জগন্নাথ
মিশ্র নন্দ। চৈতন্যদেবের অনুসারী ছয় জন গোস্বামী ছিলেন যারা অনেক বৈষ্ণবশাস্ত্র
রচনা করে গিয়েছেন। সে ছয় জন গোস্বামী হলেন রূপ, সনাতন, জীব, রঘুনাথ ভট্ট, রাঘনাথ
দাস এবং গোপাল ভট্ট। এছাড়াও চৈতন্যদেবের অনুসারী আটজন কবিরাজ ও চৌষট্টিজন মহন্ত
ছিলেন। সন্ন্যাস নেবার পর চৈতন্যদেব ছয় বছর মথুরায় অবস্থান করেন। তিনি পুরুষোত্তম ক্ষেত্র সহ নানা স্থান পর্যটন করে বৈষ্ণব মত
প্রচার করেন এবং শিষ্য সংগ্রহ করেন। তারপর তিনি রূপ ও সনাতনকে মথুরায় এবং অদ্বৈত ও
নিত্যানন্দকে বাংলায় প্রচারকার্যে নিযুক্ত করে নীলাচলে গমন করেন। নীলাচলে মহাপ্রভূ
জীবনের শেষ ১৮ বছর জগন্নাথের সেবায় রত ছিলেন। শেষদিকে তিনি ভাবে উন্মত্ত হয়ে
থাকতেন। কথিত আছে যে, তিনি সমুদ্রকে যমুনা ভেবে এবং শ্রীকৃষ্ণ সে যমুনার জলে
গোপীকাদের সাথে ক্রিড়া করছেন এমন উপলব্ধি করে ঐ সমুদ্রের জলে সেখানে ঝাপ দিয়েছিলেন।
এটাই প্রেমভক্তির চূড়ান্ত স্তর। ভাবের এ চূড়ামত্ম সত্মরে উপনীত হলে সর্বত্রই
প্রেমাস্পদের দর্শন মেলে। মহাপ্রভূ ১৫৩৪ খৃষ্টাদে (১৪৫৫ শকাব্দে) ইহলীলা সংবরণ
করেন। মহাপ্রভূ শিষ্যদের উপদেশ দিয়েছেন ‘‘তৃণাদপি
সুনীচেন তরুরেব সহিষ্ণুনা। অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়া সদাহরি’’ অর্থাৎ তৃণ
হতেও নীচ (নম্র) হবে, তরু হতেও সহিষ্ণু হবে, অহংকারশূন্য হয়ে সকলকে সম্মান করবে
এবং সব সময় হরিনাম করবে। চৈতন্যদেব ভক্তদের শিক্ষার জন্য আটটি শ্লোক রচনা করে
গিয়েছিলেন যা শিক্ষাষ্টক নামে পরিচিত।
তুলসীদাস
তুলসীদাস ছিলেন একজন রামভক্ত। তিনি গৃহস্থ-আশ্রমে থাকাকালে স্ত্রীকে খুব
ভালবাসতেন। একদিন তিনি গৃহের বাইরে থাকাকালে তাঁর স্ত্রী পিতৃ-গৃহে গমন করেন। তিনি
গৃহে ফিরে স্ত্রীকে দেখতে না পেয়ে প্রণয়বশত শ্বশুর বাড়ি গিয়ে স্ত্রীর নিকট উপস্থিত
হন। স্ত্রী তাঁর এ নির্লজ্জ স্বভাবের জন্য তাঁকে তিরষ্কার করেন। স্ত্রীর ভৎর্সনা
শুনে তাঁর মনে তীব্র বৈরাগ্য আসে এবং তিনি গৃহ ত্যাগ করে শ্রীরামচন্দ্রের উপাসনা
শুরু করেন। কথিত আছে তিনি চিত্রকুটে হনুমাজীর দর্শন পান। তাঁর হিন্দী ভাষায় অনুদিত
রামায়ণের নাম রামচরিতমানস। এ রামচরিতমানস গ্রন্থই তাঁর অমর কীর্তি।
কোন মন্তব্য নেই