Header Ads

শিবলিঙ্গ এবং শিব সম্পর্কিত কতিপয় প্রশ্নোত্তর



) শিবলিঙ্গ কি?


২) শিবলিঙ্গের অর্থ কী?



) শিবলিঙ্গ পূজার তাৎপর্য কি ?



অনেকের মনেই এরকম প্রশ্ন আছে যে, সকল পূজায় দেবদেবীর প্রতিমা স্থাপন করে পূজা হয় কিন্তু শিব পূজা কেনো শিবলিঙ্গ স্থাপন করে করা হয়? শিবলিঙ্গ কি, শিবলিঙ্গ পূজার তাৎপর্য কি?

শিবলিঙ্গ হল মহাদেবকে ধারণা করার বা উপলব্ধি করার নিমিত্তে একটি প্রতীক বা চিহ্ন। ধ্যানমগ্ন শিবকে (মহাদেবকে) এই প্রতীকের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়। আমরা যেমন ধোয়া দেখে আগুনের অস্তিত্ব অনুধাবন করি, তেমনি শিবলিঙ্গের মাধ্যমে শিবের অস্তিত্ব উপলব্ধি করি।

হিন্দু মন্দিরগুলিতে সাধারণত শিবলিঙ্গের মাধ্যমে শিবের পূজা হয়। একটি সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ী শিবলিঙ্গ হচ্ছে শিবের আদি অন্তহীন সত্ত্বার প্রতীক এবং এটি আদি অন্তহীন স্তম্ভেরও রূপবিশেষ।
নৃতত্ত্বারোপিত মূর্তি ব্যতিরেকেও শিবলিঙ্গ বা লিঙ্গ-এর আকারে শিবের পূজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।

সংস্কৃত लिङ्गं,(লিঙ্গ); শব্দের অর্থ হলো "প্রতীক" বা চিহ্ন। ব্যাকরণ অনুসারে লিঙ্গ চার প্রকার, যথা-পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ, উভয়লিঙ্গ, ক্লীবলিঙ্গ।  সুতরাং ভাষাগত যে তথ্যের দ্বারা কোন মানুষকে প্রাণীকে পুরুষ বা স্ত্রী প্রজাতি হিসেবে, কিংবা কোন প্রাণহীন জিনিসকে বস্তুগত বিষয় হিসেবে আলাদা আলাদাভাবে সনাক্ত করা যায় তাই লিঙ্গ। 
শিব

বস্তুত ”শিবলিঙ্গ” বলতে কোন জননেন্দ্রিয় বোঝায় না। “শিব” শব্দের অর্থ মঙ্গলময় এবংলিঙ্গ” শব্দের অর্থ প্রতীকএই কারণে শিবলিঙ্গ শব্দটির অর্থ সর্বমঙ্গলময় বিশ্ববিধাতার প্রতীক। ১৯০০ সালে প্যারিসে ধর্মীয় আলোচনায় শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস'র শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, "শিবলিঙ্গ ধারণাটি এসেছে অথর্ববেদ সংহিতা গ্রন্থে যূপ-স্তম্ভ বা স্কম্ভ নামক এক প্রকার বলিদান স্তম্ভের স্তোত্র থেকে, কারণ এখানেই প্রথম শিবলিঙ্গ পূজার কথা জানা যায়। এই স্তোত্রে আদি অন্তহীন এক স্তম্ভ বা স্কম্ভ-এর বর্ণনা পাওয়া যায়। এই স্তম্ভটি চিরন্তন ব্রহ্মের স্থলে স্থাপিত। যজ্ঞের আগুন, ধোঁয়া, ছাই, সোম লতা এবং যজ্ঞকাষ্ঠবাহী ষাঁড়ের ধারণাটির থেকে শিবের উজ্জ্বল দেহ, তাঁর জটাজাল, নীলকণ্ঠ বাহন বৃষের একটি ধারণা পাওয়া যায়। তাই মনে করা হয়, উক্ত যূপস্তম্ভই কালক্রমে শিবলিঙ্গের রূপ ধারণ করেছে। লিঙ্গপুরাণ গ্রন্থে এই স্তোত্রটিই উপাখ্যানের আকারে বিবৃত হয়েছে। এই উপাখ্যানেই কীর্তিত হয়েছে সেই মহাস্তম্ভ মহাদেব রূপে শিবের মাহাত্ম্য"

প্রকৃতপক্ষে জার্মান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ গুস্তাভ ওপার্ট শালগ্রাম শিলা শিবলিঙ্গের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে তাঁর গবেষণাপত্রে এগুলিকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গে সৃষ্ট প্রতীক বলে উল্লেখ করলে তারই প্রতিক্রিয়ায় স্বামী বিবেকানন্দ এই কথাগুলো বলেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, শালগ্রাম শিলাকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গ বলাটা এক কাল্পনিক আবিষ্কার মাত্র। তিনি আরও বলেছিলেন, শিবলিঙ্গের সঙ্গে পুরুষাঙ্গের তুলনা বৌদ্ধধর্মের পতনের পর বিদেশ হতে আগত ভারতের অন্ধকার যুগে কিছু অশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি শাসকের মস্তিস্কপ্রসূত উদ্ভট বানোয়াট গল্প। শ্রী স্বামী শিবানন্দও শিবলিঙ্গকে যৌনাঙ্গের প্রতীক বলে স্বীকার করেননি। ঔপন্যাসিক ক্রিস্টোফার ইসারউড লিঙ্গকে যৌন প্রতীক মানতে চাননি। ১৮৪০ সালে এইচ. এইচ. উইলসনও এই একই কথা বলেছিলেন।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় "Lingam/Lingham" ভুক্তিতেও শিবলিঙ্গকে যৌন প্রতীক বলা হয়নি। যদিও অধ্যাপক ডনিগার পরবর্তীকালে তাঁর “দ্য হিন্দুজ: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রিবইতে নিজের বক্তব্য পরিষ্কার করে লিখেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো কোনো ধর্মশাস্ত্রে শিবলিঙ্গকে ঈশ্বরের বিমূর্ত প্রতীক বা দিব্য আলোকস্তম্ভ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এইসব বইতে লিঙ্গের কোনো যৌন অনুষঙ্গমূলক অর্থ নেই। তাই শিবলিঙ্গ কোনক্রমেই স্ত্রী-পুরুষের মিলিত অঙ্গ বা পুরুষাঙ্গ নয়।  প্রকৃতপক্ষে শিবলিঙ্গে এমন এক নিগূঢ় অনির্বচনীয় শক্তি আছে, যা সহজেই ভক্তবৃন্দের ভেতর মহাদেবের প্রতি ভক্তি আরও বেশি নিবিষ্ট করে। বিশেষভাবে লক্ষ্য করলে এই ভক্তির ভাব অনুধাবন করা যায়। আর এজন্যই, শিবলিঙ্গের এমন সুন্দর তাৎপর্য একমাত্র বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী ধর্মচারী ভক্তবৃন্দরাই বুঝতে পারে।

শিবের অনুচর নন্দী এবং ভৃঙ্গী গাঁজা ও মদ্য সেবন করেন কেনো?

“নন্দী” শব্দের উৎপত্তি নন্দ ধাতু থেকে, যার মানে আনন্দ।ভৃঙ্গীএসেছে ভৃ ধাতু থেকে, যার মানে ভরণ, পোষণ ধারণ করা। আর এটা  তো স্বাভাবিক; যেখানে মঙ্গল যাবে সেখানে তার প্রিয় অনুচর আনন্দ, ভরণ-পোষণ ধারণ চলে যাবে। নন্দীর আগমনের সাথে আসে প্রেরণা; অর্থ্যাৎ মানুষের মধ্যে বেড়ে ওঠে সহ্য, ধৈর্য্য অধ্যবসায়ের মত গুণগুলো। অপরপক্ষে ভৃঙ্গী হল কারক। সমাজ সংসারে চলতে হলে মানুষের মধ্যে এইসব গুণ থাকা একান্ত প্রয়োজন
 
বস্তুত সিদ্ধি গাঁজা হলো কর্মে কৃতার্থ হওয়ার পরমান্দ তথা আত্মপ্রসাদের প্রতীক, যা কখনোই পৃথিবীতে দেখতে পাওয়া কোনো মাদক দ্রব্য নয়। নন্দী যিনি আনন্দদায়ীর কারক ভৃঙ্গী যিনি ভরণ-পোষণের কারক; এই দুই বিহিত ব্যাবহার অনুশীলনের ভিতর দিয়েই জেগে ওঠে কার্যসিদ্ধির সৌন্দর্য্য। আর প্রকৃত শিবভাব সম্পন্ন ব্যাক্তিত্বই হল কার্যসিদ্ধির উৎস। তাই, প্রকৃত শিবভাব বিশিষ্ট ব্যাক্তি কর্মে কৃতার্থ হওয়ার পরমান্দ তথা আত্মপ্রসাদকে সেবন করে আনন্দ লাভ করে।

শিবলিঙ্গে জল বা দুধ ঢালা হয় কেনো?

সমুদ্র মন্থনের সময় হলাহল নামক মারাত্মক বিষ উত্থিত হয়েছিল, যেটার চারিদিকে ছড়িয়ে যাবার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল জীবের জীবন বিপন্ন করার ক্ষমতা ছিল অত্যধিক। ভগবান শিব সকল দেবতাদের অনুরোধে এই মারাত্মক বিষ থেকে সবাইকে রক্ষা করার ঐশ্বরিক দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব সম্পন্নের জন্যই তিনি সমস্ত বিষ পান করেন এবং তার কন্ঠে সংরক্ষণ করে রেখে দেন; 
  
আর এজন্যই মহাদেবের কণ্ঠদেশ নীলবর্ণ হয়ে যায়। হলাহল বিষের বিষাক্ততা মাত্রা ছিল প্রচণ্ড রকমের বেশি, যদিও এটি ভগবান শিবের উপর কোন প্রভাব ফেলে নাই। কিন্তু হলাহল বিষের তাপমাত্রা ছিল অত্যন্ত বেশি। এই তাপমাত্রার প্রভাব প্রশমিত করার জন্য দেবতারা মহাদেবের জন্য গঙ্গা-অভিষেক (স্নান) করেন, আর এই গঙ্গা-অভিষেকের মাধ্যমে দেবতারা শিবকে প্রসন্ন করেছিলেন। ভগবান শিবের সেই গঙ্গা অভিষেকে শুধুমাত্র সাপ এগিয়ে এসেছিল এই ঐশ্বরিক কারণ সমর্থনের জন্য। তারা নিজেরাও বিষের কিছু অংশ পান করে তাদের বিষদাঁতে কিছু বিষ গ্রহণ করে। এজন্য সেদিন থেকেই কিছু সাপ বেশি বিষাক্ত হয়ে ওঠে। সমুদ্র মন্থনের সময় যে গঙ্গা-অভিষেক করা হয়েছিল বলেই শিব-উপাসকগণ শিবলিঙ্গে জল বা দুধ ঢেলে শিবের প্রতি ভক্তি ভালোবাসা প্রকাশ করেন। সুতরাং শিবের পূজায় শিবলিঙ্গে এরকম জল বা দুধ ঢালা খুবই গুরুত্বপূর্ণ; অভিষেক ছাড়া শিবের পূজা অসম্পূর্ণ। অভিষেকের সময় এই জল বা দুধ ঢালা খুবই পবিত্র। কারণ অভিষেকের দ্বারাই শিবের প্রতি ভক্তদের গভীর অনুরক্তি প্রকাশিত হয়, আর এর মাধ্যমেই ভক্তিপরায়ণতা ফুটে উঠে।

                                                          
সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্ 

                 লেখক- প্রণব সরকার, স্নাতক (কৃষি অর্থনীতি), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।




৩টি মন্তব্য:

Akash Bairagi. Blogger দ্বারা পরিচালিত.