Header Ads

শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় কতিপয় অমৃতকথন


শ্রীকৃষ্ণ শব্দের অর্থ

শ্রীকৃষ্ণের শ্রীশব্দটি উৎপন্ন হয়েছেও ‘র’ এর সাথে ‘ঈ’ যোগেশ’ হল রজোগুণের বীজমন্ত্র যার দ্বারা মানুষ কর্মে সকৃয় হয়, শক্তি প্রদর্শন করে, বিদ্যা-বুদ্ধির প্রদর্শন করে। আর ‘র’ হল শক্তির বীজমন্ত্র।কৃষ্ণ’ শব্দের তিনটি অর্থ। সংস্কৃত  কৃষ ধাতুর অর্থ চর্চা করা বা খোঁজ করা। মানুষ অনুশীলনের দ্বারা, সাধন-ভজনের দ্বারা যে সত্তাকে অধিগত করে তাকে বলা হয়কৃষ্ণঅর্থাৎ গভীরতর অনুশীলন তথা সাধনার দ্বারা মানুষ যাকে পায়, তিনিইকৃষ্ণকৃষধাতুর দ্বিতীয় অর্থ হল আকর্ষণ করা অর্থাৎ সব কিছুকে নিজের দিকে আকর্ষণ করা। এই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ডকে যিনি নিজের দিকে আকর্ষণ করে চলেছেন তিনিকৃষ্ণ কালো রঙের শোষণ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি, তাই সংস্কৃত ভাষায় কালকে কৃষ্ণ বলা হয়।  
Krishna

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মরহস্য

প্রায় সাড়ে তিন হাজার বৎসর পূর্বে শুভ অষ্টমী তিথিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অবতীর্ণ হওয়ার কারণ দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কি সত্যিই এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন? যদি তাই হয় তবে কেন তিনি ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর শ্রীমদ্ভাগবতে সুস্পষ্ট সেখানে বলা হয়েছে- বলদর্পিত সংখ্যাতীত নৃপতি রূপে লক্ষ লক্ষ দৈত্য দৈত্যসৈন্য দ্বারা এই পৃথিবী অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। পৃথিবী গো-রুপ ধারণ করে অশ্রুপূর্ণ বদনে করুণ কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে ব্রহ্মা সমীপে উপস্থিত হয়ে তাঁকে নিজ বিপদ বার্তা জ্ঞাপন করিলেন। ব্রহ্মা পৃথিবীর সেই করুণ বাক্য শুনে সমাহিতভাবে দেবাদিদেব জগন্নাথকে পূরুষসূক্তে স্তব করতে লাগিলেন। ব্রহ্মা সমাধি অবস্থায় আকাশবাণী শ্রবণ করে দেবগণকে বললেন, হে অমরগণ, পৃথিবীর এই দুঃখ ভগবান পূর্ব হতেই অবগত আছেন; অতএব যতদিনে না সেই দেবাদিদেব হরি অবতীর্ণ হয়ে স্বীয় কালশক্তির দ্বারা পৃথিবীর ভারাপনোদনপূর্বক ভূতলে বিচরণ করেন, ইতিমধ্যে তোমরা সকলে অংশক্রমে যদুবংশে জন্মগ্রহণ কর” (শ্রীমদ্ভাগবত, দশম স্কন্ধ, প্রথম অধ্যায়)। এই কারণেই সাক্ষাৎ পরমপুরুষ ভগবান শূরবংশীয় বাসুদেব ভবনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন

একদা মথুরাপুরে শূরবংশীয় বাসুদেব বিবাহ করে নব-বিবাহিতা দেবকীর সাথে স্বগৃহে গমন করার জন্য রথারোহণ করলেন। উগ্রসেন নন্দন কংস ভগিনীর প্রিয়-কামনায় স্ব-হস্তেই অশ্ব-রশ্নি ধরে ছিলেন। পথে যেতে যেতে সহসা এক দৈববাণী, অশ্ব-রশিধারী কংসকে সম্বোধন করিয়া বলল, “রে মূর্খ ! তুই যাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিস রই অষ্টম-গর্ভজাত সন্তান তোকে বধ করবে দৈববাণী শোনার পর কংস ভগিনীকে বধ করতে উদ্যত হল। বসুদেব দেবকীর প্রাণ রক্ষার্থে কংসকে এই বলে নিরস্ত করল যে, “যা হতে তোমার ভয় উৎপন্ন হয়েছে,এ সেই পুত্রদিগকে আমি তোমার কাছে সমর্পণ করব একে একে সর্বদেবময়ী দেবকীর ছয়টি পুত্র কংসের হাতে নিহত হল। অতঃপর দেবকীর অষ্টম গর্ভ উপস্থিত। কাল যখন সকল গুণান্বিত অতীব রমনীয় হয়ে উঠল, নদীসকল প্রসন্ন-জলসম্পন্ন হয়ে উঠল, হ্রদসকল প্রস্ফুট পদ্মশোভা ধারণ করল, পাখি সকল কলধ্বনি তুলল, পবিত্র মৃদুমন্দ বায়ু বইতে লাগল। দেবগণ সাধুগণের মন প্রসন্ন হয়ে উঠল, তাহারা প্রীতি-প্রফুল্ল হয়ে পুস্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। সর্বান্তর্য্যামী বিষ্ণু তখন পূর্বদিক হতে পূর্ণ চন্দ্রের মত দেবীরূপিণী দেবকীর গর্ভ হতে আবির্ভূত হলেন।

কৃষ্ণ অবতারের উদ্দেশ্য

কেন তিনি ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন? শ্রী কৃষ্ণ অবতারের দুইটি উদ্দেশ্য- () অন্তর্জগতে মানবাতার উন্নতি সাধন এবং (২) বাহ্য-জগতে মানব সমাজের রাষ্ট্রীয় বা নৈতিক পরিবর্তন সাধন। বুদ্ধ, খ্রীস্ট, শ্রী চৈতন্য প্রভৃতিকেও অবতার বলা হয়। কিন্তু সকল অবতারের অসুর বিনাশ নাই। সকল অবতারের একমাত্র উদ্দেশ্য হইতেছে মানবতাকে দিব্য প্রেম- পবিত্রতা-জ্ঞান-শক্তির অনুপ্রেরণা দেওয়া কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অবতারের দুইটিই আছে। বাহ্যতঃ দুস্কৃতিদিগের বিনাশ করিয়া সাধুদিগের সংরক্ষণ ধর্মরাজ্য সংস্থাপন। দ্বিতীয়তঃ মানবকে দিব্য কর্মের আদর্শ দেখিয়ে দিব্য জীবনের অধিকারী করা।  

শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত বাণী

যা ভগবতা গীতা সা গীতা” অর্থাৎ ভগবান যা বলেছেন তাই গীতা। শ্রীমদ্ভগবত গীতা শুধু একটি ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, এটি একটি দার্শনিক গ্রন্থ এবং একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। এই গীতাতেই ভগবান বলেছেন, আমাদের কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়। তিনি অর্জুনের মাধ্যমে সমস্ত মানব জাতিকে জানিয়েছেন, বুঝিয়েছেন তাদের কি করা উচিত আর তিনি কি করতে পারেন। প্রথমে আসা যাক আমাদের কি করা উচিত এই প্রসঙ্গে।ভগবান গীতার শ্লোকে বলেছেন-
     ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বযুৎপপদ্যতে,
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।
                                                                                                            শ্রীশ্রীগীতা /
হে পার্থ, কাতর হয়ো না। এইরূপ পৌরুষহীনতা তোমাতে শোভা পায় না। হে, পরন্তপ, হৃদয়ের তুচ্ছ দুর্বলতা ত্যাগ করে (যুদ্ধার্থে) উত্থিত হও যুদ্ধ বলতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ বোঝায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন যখন দেখল যে তার নিজের আত্মীয় পরিজন, ভাই, বন্ধু তার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তখন তিনি ভগবানকে বললেন, হে ভগবান আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমি এই যুদ্ধ করতে পারব না। আমি আমার আত্মীয় পরিজনদের বধ করতে পারব না তার চেয়ে দুর্যোধন আমাকে মারলেও আমার মঙ্গল। তখন ভগবান উপরি-উক্ত কথা অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন। সমাজে ভাল মন্দ দুই আছে। যখনই মন্দের আধিক্য হয় তখনই ভগবান সেই মন্দের বিনাশ করেন। অর্থাৎ আমাদেরও উচিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, যে কথা ভগবান স্বয়ং গীতাতে বলেছেন। ভগবান গীতাতে এও বলেছেন, হে অর্জূন তুমিতো নিমিত্ত মাত্র, সকল দুর্জনকে আমি আগেই বিনাশ করেছি। তুমি না হলেও আমি অন্য কাউকে দিয়ে তাদেরকে বিনাশ করব। প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন নয়, সকল হিন্দু-জাতিকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করতে বলেছেন।

শ্রীকৃষ্ণ চতুর্থ অধ্যায়ের এগারো নম্বর শ্লোকে বিভিন্ন মত ও পথের যে সমন্বয় ঘটিয়েছেন সত্যই তা অতুলনীয়। তিনি বলেছেন- হে পার্থ, যে আমাকে যেভাবে উপাসনা করে, আমি তাকে সেইভাবেই তুষ্ট করি। কৃষ্ণ যখন আর্বিভূত হয়েছিলেন, তখন বহু ধর্মমত প্রচলিত ছিল, বহু উপধর্মেরও সৃষ্টি হয়েছিল। যে সনাতন যোগধর্ম বহুবার প্রচারিত হয়ে বহুবার লয় পেয়েছে, শ্রীকৃষ্ণ তাই পুনরায় প্রচলন করলেনকেউ যদি স্বর্গ চায় তাহলে সে স্বর্গ পাবে কিন্তু ঈশ্বরকে পাবে না। আবার কেউ যদি টাকা-পয়সা, বাড়ী-গাড়ি, মান-সম্মান চায় সেগুলো সে পেতে পারে কিন্তু পরম পুরুষকে পাবে না। আর যে শুধুই ভগবানকে চায় সে কথনই বৈষায়িক ধন-সম্পদের আশা করে না-এটাই গীতার উৎকৃষ্ট শিক্ষা।

গীতোজ্ঞ ধর্মকে কেউ বলেন নিস্কাম কর্মযোগ, কেউ বলেন এটা কর্মসাপেক্ষ জ্ঞানযোগ, কেই বলেন এটা কর্ম-জ্ঞানমিশ্র ভক্তিযোগ। বস্তুতঃ এতে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি- তিনেরই সমন্বয়। আমাদের সকলেরই একটাই চাওয়া থাকা উচিত, তাহল  সেই পরম পুরুষের কৃপালাভ বা মোক্ষলাভ। আর মোক্ষলাভের জন্য প্রয়োজন গীতোক্ত ধর্মকে সঠিকভাবে জানা। গীতোক্ত ধর্মকে সঠিকভাবে জানলে আমরা সহজেই আমাদের আরাধ্য পরমপুরুষকে পাব।

রাধা-কৃষ্ণের সূক্ষ্ম দর্শন

মানুষ যদি তার আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটাতে চায়, তখন তাকে নিজের জীব ভাবকে টেনে উপরের দিকে তুলতে হবে। শাস্ত্রের ভাষায় এই জীবভাবকে বলেকুলকুণ্ডলিনী এই জীবভাব বা কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে, তন্ত্রশাস্ত্রে  রাধা নামে অভিহিত করা হয়। আর সহস্রার চক্রের যেটা নিয়ন্ত্রণ বিন্দু অর্থ্ৎ যেখান থেকে মানব দেহের সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়, ঐ বিন্দুকে তন্ত্রের ভাষায়  বলেকৃষ্ণ”। এই কুলকুণ্ডলিনী যখন সহস্রার চক্রে উপনীত হয় অর্থাৎ রাধা- কৃষ্ণের মিলন ঘটে তখন মানুষের মোক্ষ লাভ হয়। সাধারণ মানুষ সাধনার প্রাথমিক স্তরে কৃষ্ণ ও রাধাকে দেহধারী মানব-মানবীর মত মনে করে। তবে মানুষ ‍যখন সাধনার উচ্চ স্তরে উপনিত হয়, তখন সে রাধা-কৃষ্ণকে জীব-সত্ত্বা ও ঈশ্বর সত্ত্বা রূপে চিন্তা করে। তখন সে দেহধারী রাধা-কৃষ্ণকে বাইরে না খুজে দেহের মধ্যেই যে হৃদি-বৃন্দাবন রয়েছে সেখানে তাঁদের সন্ধান করে।

কোন মন্তব্য নেই

Akash Bairagi. Blogger দ্বারা পরিচালিত.