Header Ads

হিন্দু সাধক

হিন্দু সাধক
যুগেযুগে বিভিন্ন মুনি-ঋষি, বিভিন্ন সাধক আবির্ভূত হয়ে পূণ্যভূমি ভারতবর্ষকে ধন্য করেছেন। ঐসব সাধকগণ মর্ত্যলোকে এসে শুধু তপস্যায় মগ্ন থাকেন নি-তাঁরা ত্রাণ করেছেন মর্ত্যের তাপিত জীবকুলকে। সাধকগণই সাধারণ মানুষকে যথার্থ ধর্মশিক্ষা দিয়ে গেছেন। নিম্নে কিছু ভারতবর্ষীয় সাধকের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হল।

শঙ্করাচার্য
শঙ্করাচার্য ৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই বৈশাখ শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে কেরল দেশের মালবার প্রদেশের কালাডি গ্রামের নম্বুরি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শিবগুরু এবং মাতার নাম বিশিষ্টা দেবী। ভগবান শঙ্করের বরেই শঙ্করের জন্ম বলে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল শঙ্কর। শঙ্করের বয়স তিন বৎসর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। শিশুকাল থেকেই শঙ্কর ছিলেন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন শ্রুতিধর অর্থাৎ সবকিছু শুনেই আত্মস্থ করতে পারতেন। তিনি পাঁচ বছর বয়সে বেদ অধ্যয়নের জন্য উপনয়ন দিয়ে গুরুগৃহে গমন করেন।

দুই বৎসরের মধ্যে অর্থাৎ সাত বৎসর বয়সেই বেদ-বেদাঙ্গ পাঠ সমাপ্ত করে ফেলেন। শঙ্করের মাতা বিশিষ্ট দেবী গৃহ থেকে বেশ দূরে আলোয়াই নদীতে স্নান করতে যেতেন। একদিন স্নান করে গৃহে ফেরার পথে বিশিষ্ট দেবী ক্লান্তিবশত মুর্ছিতা হয়ে পড়লেন। শঙ্কর মাকে সেবা-শুশ্রূষার দ্বারা সুস্থ করে তুললেন এবং মাকে যাতে দূরে গিয়ে স্নান করতে না হয়, সেজন্য আলোয়াই নদীকে তাঁদের গৃহের নিকট হতে প্রবাহিত হওয়ার অনুরোধ জানালেন। তারপর থেকে আলোয়াই নদী তাঁদের গৃহের নিকট হতে প্রবাহিত হতে থাকল। সত্যি এরকম মাতৃভক্তি জগতে বিরল।

একদল জ্যোতিষী শঙ্করের কোষ্ঠী বিচার করে দেখলেন যে, শঙ্করের আয়ু মাত্র আট বৎসর তবে তপস্যা প্রভাবে আরও আট বৎসর বর্ধিত হতে পারে। একথা শুনে শঙ্করের মনে সন্ন্যাস নেয়ার ইচ্ছা জাগল। কিন্তু মাতা তাঁকে সন্ন্যাস গ্রহণ করার অনুমতি দিলেন না। একদিন শঙ্কর আলোয়াই নদীতে স্নান করার সময় একটা কুমির তাঁকে ধরে গভীর জলে নিয়ে যেতে লাগল। মাতা তাঁকে রক্ষা করতে ছুটে আসলে ‘‘মা, সন্ন্যাসের অনুমতি দাও’’ বলে শঙ্কর চিৎকার শুরু করলেন। মাতা তখন সন্ন্যাসের অনুমতি দেওয়ার সাথে সাথে কুমির শঙ্করকে ছেড়ে দিল। এভাবে শঙ্কর অলৌকিক উপায়ে মাতার নিকট সন্ন্যাসের অনুমতি নিয়ে গৃহত্যাগ করলেন। তবে যাওয়ার আগে তিনটি প্রতিজ্ঞা করে গেলেন। প্রতিজ্ঞা তিনটি এরকম- তিনি মায়ের মৃত্যুকালে তাঁকে দর্শন দিবেন, মায়ের মৃত্যুকালে তাঁকে ভগবান দর্শন করাবেন এবং তিনি নিজে মায়ের সৎকার করবেন।

শঙ্কর গৃহত্যাগ করে নর্মদা-তীরে এসে গোবিন্দপাদ নামক এক সিদ্ধ-পুরুষের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শঙ্করাচার্য গুরুর নির্দেশে বেদান্ত প্রচারের জন্য কাশীধাম গমন করেন। পরে সেখান থেকে বদরিকা আশ্রমে এসে গুরুর নির্দেশমত উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র ও গীতার ভাষ্য রচনা করেন। শঙ্করের বয়স ষোল বৎসর পূর্ণ হলে মহর্ষী ব্যাসদেব এসে তাঁর আয়ু আরও ষোল বৎসর বর্ধিত করে যান।

শঙ্কর বেদান্ত প্রচারের নিমিত্ত সশিষ্য ভারতের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন এবং বিভিন স্থানের পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে বেদামন্ত দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। তিনি আকাশ-পথে উড়ে এসে মীমাংসাকার কুমারিল ভট্টের শিষ্য মণ্ডনকে তর্কশাস্ত্রে পরাজিত করেন। একদিন শঙ্করের পাণ্ডিত্ব্যে ইর্ষান্বিত হয়ে উগ্রভৈরব, ক্রবাচ প্রভৃতি কাপালিকরা তাঁকে হত্যা করতে এসে অলৌকিক উপায়ে উল্টো নিজেরাই নিহত হন।

শঙ্করাচার্য একদিন সূক্ষ্মদেহে অমরুক নামক রাজার মধ্যে প্রবেশ করে স্ত্রী সম্বন্ধে অনেক বিষয় শিক্ষা অর্জন করে একটি স্ত্রী-চরিত্র সম্বন্ধীয় গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি মাতা বিশিষ্টা দেবীর মৃত্যুর পূর্বকালে শূন্যপথে মায়ের নিকট উপস্থিত হয়ে পূর্বের তিনটি প্রতীজ্ঞা পালন করেন। শঙ্করাচার্য কাশী, কাঞ্চী, কর্ণাট, কামরূপ প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করে বেদান্ত মত প্রচার করেছিলেন। জীবনের শেষদিকে তিনি কাশ্মীর গমন করেন। সেখানের প্রচারকার্য শেষ হলে বদরিকাশ্রমে চলে যান এবং শিষ্যদের তাঁর প্রতিষ্ঠিত মঠে গিয়ে প্রচারকার্য করার নির্দেশ দেন। কিন্তু শিষ্যরা গুরুসঙ্গ ত্যাগ করতে সম্মত না হওয়ায় তাঁদের সঙ্গে কিছুদিন হিমালয়ের কেদারধামে বাস করেন। তারপর সেখানে তাঁর বয়স বত্রিশ বৎসর পূর্ণ হলে মহাসমাধি যোগে তিনি দেহত্যাগ করেন।

রামানুজ
সাধক রামানুজ কেশব ত্রিপাঠীর ঔরসে ভূমিদেবীর গর্ভে মাদ্রাজের পেরুম্বুর নামক স্থানে ১০১৭ মতান্তরে ১০৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কাঞ্চীপুরে শিক্ষা লাভ করেন এবং কাবেরী নদীর দুই শাখার মধ্যবর্তী শ্রীরঙ্গদ্বীপে শ্রীরঙ্গনাথের উপাসনা করেন। শ্রীরঙ্গধামে বসে তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ভারতবর্ষের নানা স্থানের নানা পণ্ডিতদের তর্কবিচারে পরাজিত করেন। ব্যঙ্কট-গিরি নামক স্থানে তিনি বিষ্ণু-মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কর্ণাটে বেতালদেব নামক এক রাজা ছিলেন। রাজা বেতালদেব ছিলেন জৈন ধর্মের উপাসক। রামানুজ রাজা বেতালদেবের কন্যাকে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত করায় রাজা রামানুজের নিকট বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তারপর তিনি কাঞ্চীপুর, মহারাষ্ট্র, দ্বারকা প্রভৃতি স্থানে বৈষ্ণব মত প্রচার করেন। পরে তিনি বারাণসী, প্রয়াগ, হরিদ্বার প্রভৃতি তীর্থ ভ্রমণ করেন। রামানুজ ১০৫৭ মতান্তরে ১০৭৭ সালে  ৪০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

মাধ্বাচার্য
মাধ্বী সম্প্রদায়ের প্রবর্তক মাধ্বাচার্য দক্ষিণাপথে ১১২১ শকাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মধিজী ভট্ট। কথিত আছে মহর্ষি ব্যাসদেব সাধক মাধ্বাচার্যকে তিনটি শালগ্রাম শিলা উপহার দেন এবং তিনি সুব্র‏‏হ্মণ্য, উদিপি ও মধ্যতল নামক স্থানের তিনটি মঠে ঐ শালগ্রাম শিলা প্রতিষ্ঠিত করেন। এর মধ্যে উদিপি নগর মধ্বচারীদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র। এছাড়াও তিনি আটটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেই আটটি মন্দিরে তিনি রাম-সীতা, লক্ষ্মণ ও সীতা, দ্বিভূজ, কালীয়মর্দন, চতুর্ভূজ, সুবিতল, সুকর, নৃসিংহ এবং বসমত্ম-বিতল এই আট প্রকার মূর্তি স্থাপন করেন। মধ্বাচার্য উদীপী মঠে বসে দশোপনিষদ ভাষ্য, ব্র‏‏হ্মসূত্র ভাষ্য, অনুবাকানুনয়বিবর্ণ, অনুবেদান্তরস প্রকরণ, ভারত-তাৎপর্য নির্ণয়, ভাগবত-তাৎপর্য, গীতা-তাৎপর্য, কৃষ্ণামৃত মহার্ণব তন্ত্রসার প্রভৃতি ৩৬ খানা গ্রন্থ রচনা করেন।

জয়দেব
বীরভূমের প্রায় দশ ক্রোশ দক্ষিণে অজয় নদের তীরে কেন্দুলি গ্রামে বৈষ্ণব সাধক জয়দেবের জন্ম। জয়দেব প্রথম জীবনে সন্ন্যাসী ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে পদ্মাবতী নামক এক ব্র‏‏হ্মণকন্যার পাণি গ্রহণ করেন। গার্হস্থ্য আশ্রমে প্রবেশের পর তিনি ‘‘গীতগোবিন্দ’’ নামক একখানা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কথিত আছে যে, নীলাচলের রাজাও ‘‘গীতগোবিন্দ’’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। দুইটি গ্রন্থই জগন্নাথদেবের সামনে রাখা হলে জগন্নাথদেব জয়দেবের গ্রন্থ বক্ষে ধারণ করলেন এবং ঐ রাজার গ্রন্থ মন্দিরের বাইরে নিক্ষেপ করলেন। এভাবে সাধক জয়দেবের ‘‘গীতগোবিন্দ’’ অমর হয়ে থাকল।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ ১৪৮৬ খৃষ্টাব্দে (১৪০৭ শকাব্দে) ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায় নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতার নাম শচীদেবী। জগন্নাথ মিশ্র পূর্বে শ্রীহট্টে বাস করতেন। পরে তিনি গঙ্গাবাসের উদ্দেশ্যে নবদ্বীপে বাস করা শুরম্ন করেন। অল্প বয়সেই চৈতন্যদেব পিতাকে হারান। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিশ্বরূপ পিতার মৃত্যুর পূর্বেই সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। শ্রীচৈতন্যবাল্যে নিমাই নামে পরিচিত ছিলেন। নিমাই গঙ্গাদাস পণ্ডিতের পাঠশালায় কৃষ্ণানন্দ, কমলাকান্ত, মুরারী গুপ্ত প্রভৃতি সহপাঠীদের সাথে শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি নবদ্বীপের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীদেবীকে বিয়ে করেন। তিনি বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তির জোড়ে ক্রমান্বয়ে নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হয়ে ওঠেন এবং নবদ্বীপে অধ্যাপনা শুরু করেন। নিমাই পিতা জগন্নাথ মিশ্রের পিতৃভূমি পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্ট (বর্তমান সিলেট) ভ্রমণকালে তাঁর স্ত্রী সর্পদংশনে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর তাঁকে রাজপণ্ডিত সনাতনের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে বিবাহ দেয়া হয়। গয়ায় পিতৃদেবের পিণ্ড দিতে গিয়ে মাধবেন্দ্রপুরির শিষ্য ঈশ্বরপুরির নিকট দীক্ষাগ্রহণ করে ফিরে আসেন। দীক্ষাগ্রহণের পর থেকে নিমাইয়ের অনেক পরবর্তন লক্ষ্য করা গেল। ধীরে ধীরে নিমাই টোলের অধ্যাপক থেকে কৃষ্ণপ্রেমীক হতে শুরু করলেন। ২৪ বছর বয়সে নিমাই মাতা ও স্ত্রীকে ত্যাগ করে কাঠোয়াতে এসে সন্ন্যাসী কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তখন তার নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। সন্নাস নেয়ার পর চৈতন্যদেব একবার নবদ্বীপের কাছে শান্তিপুরে অদ্বৈতের বাড়িতে এসেছিলেন। সেখানে তিনি মাতা শচীদেবীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু সন্ন্যাসীদের স্ত্রী-সাক্ষৎ নিষিদ্ধ বলে বিষ্ণুপ্রিয়া চৈতন্যদেবকে দর্শন করতে পারেন নি। শান্তিপুর থেকে চৈতন্যদেব পুরীতে গমন করেন। পরেও আরেক বার তিনি নবদ্বীপে এসে মায়ের সাথে দেখা করেছিলেন এবং তখন বিষ্ণুপ্রিয়াকে পাদুকা দান করেছিলেন। এরপর তিনি বৃন্দাবন, প্রয়াগ, কাশী প্রভৃতি তীর্থ ভ্রমণ করেন। নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, গদাধর, শ্রীনিবাস, রামানন্দ, হরিদাস, পভৃতি বৈষ্ণবগণ ছিল তাঁর প্রধান পার্শ্বদ। এদের মধ্যে অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে চৈতন্যের দুই অঙ্গ স্বরূপ কল্পনা করা হয়। নিত্যানন্দ চৈতন্যের খুবই প্রিয়ভাজন ছিলেন। নিত্যানন্দ একবার জগাই ও মাধাই নামক নদীয়ার দুই পাপিষ্ঠ ব্রাহ্মণকুমারকে উদ্ধার করতে চাইলেন। সে লক্ষ্যে তিনি অনেক ভক্তদের সাথে নিয়ে নাম-কীর্তন করতে করতে জগাই-মাধাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। জগাই-মাধাই মদ পান করে ঘুমাচ্ছিলেন। নাম-কীর্তন শুনে তাদের ঘুম ভাঙায় তারা খুব বিরক্ত হলেন। নিত্যানন্দ বারংবার তাদেরতে হরিনাম করার অনুরোধ করলেন। মাধাই তখন ক্রোধান্বিত হয়ে নিকটস্থ একটি ভাঙ্গা কলসির টুকরা দ্বারা নিত্যানন্দকে আঘাত করল। ফলে নিত্যানন্দের কপাল কেটে রক্ত ঝরতে লাগল। চৈতন্যদেব খবর পেয়ে ঐ স্থানে ছুটে আসলেন। তিনি জগাই-মাধাই শাস্তি দেয়ার জন্য সুদর্শন চক্রকে স্মরণ করলেন। কিন্তু নিত্যানন্দ তাঁকে নিরস্ত করলেন। শত্রু কর্তৃক আঘাত পেয়েও শত্রুকে ক্ষমা করার মত উদারতা আর কি হতে পারে? নিত্যানন্দের উদারতা ও মহত্ব দেখে জগাই-মাধাইয়ের বোধোদয় হয়। অবশেষে গৌর-নিতাইয়ের পরশে জগাই-মাধাই শুদ্ধ বৈষ্ণবভক্তে পরিণত হয়। বৈষ্ণবদের মতে শ্রীচৈতন্য রাধা ও কৃষ্ণের মিলিত রূপ, নিত্যানন্দ বলরাম, অদ্বৈত সদাশিব, শচীদেবী যশোদা এবং জগন্নাথ মিশ্র নন্দ। চৈতন্যদেবের অনুসারী ছয় জন গোস্বামী ছিলেন যারা অনেক বৈষ্ণবশাস্ত্র রচনা করে গিয়েছেন। সে ছয় জন গোস্বামী হলেন রূপ, সনাতন, জীব, রঘুনাথ ভট্ট, রাঘনাথ দাস এবং গোপাল ভট্ট। এছাড়াও চৈতন্যদেবের অনুসারী আটজন কবিরাজ ও চৌষট্টিজন মহন্ত ছিলেন। সন্ন্যাস নেবার পর চৈতন্যদেব ছয় বছর মথুরায় অবস্থান করেন। তিনি পুরুষোত্তম ক্ষেত্র সহ নানা স্থান পর্যটন করে বৈষ্ণব মত প্রচার করেন এবং শিষ্য সংগ্রহ করেন। তারপর তিনি রূপ ও সনাতনকে মথুরায় এবং অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে বাংলায় প্রচারকার্যে নিযুক্ত করে নীলাচলে গমন করেন। নীলাচলে মহাপ্রভূ জীবনের শেষ ১৮ বছর জগন্নাথের সেবায় রত ছিলেন। শেষদিকে তিনি ভাবে উন্মত্ত হয়ে থাকতেন। কথিত আছে যে, তিনি সমুদ্রকে যমুনা ভেবে এবং শ্রীকৃষ্ণ সে যমুনার জলে গোপীকাদের সাথে ক্রিড়া করছেন এমন উপলব্ধি করে ঐ সমুদ্রের জলে সেখানে ঝাপ দিয়েছিলেন। এটাই প্রেমভক্তির চূড়ান্ত স্তর। ভাবের এ চূড়ামত্ম সত্মরে উপনীত হলে সর্বত্রই প্রেমাস্পদের দর্শন মেলে। মহাপ্রভূ ১৫৩৪ খৃষ্টাদে (১৪৫৫ শকাব্দে) ইহলীলা সংবরণ করেন। মহাপ্রভূ শিষ্যদের উপদেশ দিয়েছেন ‘‘তৃণাদপি সুনীচেন তরুরেব সহিষ্ণুনা। অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়া সদাহরি’’ অর্থাৎ তৃণ হতেও নীচ (নম্র) হবে, তরু হতেও সহিষ্ণু হবে, অহংকারশূন্য হয়ে সকলকে সম্মান করবে এবং সব সময় হরিনাম করবে। চৈতন্যদেব ভক্তদের শিক্ষার জন্য আটটি শ্লোক রচনা করে গিয়েছিলেন যা শিক্ষাষ্টক নামে পরিচিত।

তুলসীদাস
সাধক তুলসীদাস ছিলেন একজন রামভক্ত। তিনি গৃহস্থ-আশ্রমে থাকাকালে স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। একদিন তিনি গৃহের বাইরে থাকাকালে তাঁর স্ত্রী পিতৃ-গৃহে গমন করেন। তিনি গৃহে ফিরে স্ত্রীকে দেখতে না পেয়ে প্রণয়বশত শ্বশুর বাড়ি গিয়ে স্ত্রীর নিকট উপস্থিত হন। স্ত্রী তাঁর এ নির্লজ্জ স্বভাবের জন্য তাঁকে তিরষ্কার করেন। স্ত্রীর ভৎর্সনা শুনে তাঁর মনে তীব্র বৈরাগ্য আসে এবং তিনি গৃহ ত্যাগ করে শ্রীরামচন্দ্রের উপাসনা শুরু করেন। কথিত আছে তিনি চিত্রকুটে হনুমাজীর দর্শন পান। তাঁর হিন্দী ভাষায় অনুদিত রামায়ণের নাম রামচরিতমানস। এ রামচরিতমানস গ্রন্থই তাঁর অমর কীর্তি।

কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
তান্ত্রিক কালী-সাধকদের মধ্যে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ অগ্রগণ্য। সাধক কৃষ্ণানন্দ সপ্তদশ শতকে পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে এক পণ্ডিত-বংশে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলার সাধকগণ যখন তন্ত্রের মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছিলেন তখন আদ্যাশক্তি মহামায়া স্বয়ং তাঁকে তন্ত্রশাস্ত্রের পুনরুদ্ধার এবং তাঁর মাতৃরূপিণী বিগ্রহের পূজা করার নির্দেশ দেন। তখন কৃষ্ণানন্দ মহামায়াকে বললেন, ‘‘মা, তোমার যে রূপের পূজা আমি করব আমাকে সে রূপ দেখিয়ে দাও’’। তখন মা বললেন, ‘‘যে ভঙ্গীতে আমার এই বিগ্রহের পূজা তোমার দ্বারা প্রচলিত হবে, তা আমি মানবদেহের মাধ্যমেই দেখিয়ে দেব। এই রাত শেষে সর্ব প্রথম যে নারীকে যে রূপে যে ভঙ্গীতে দেখবে, ঐরকম মূর্তিতে আমার পূজার প্রচলন করবে। মায়ের নির্দেশমত পরদিন প্রাতেঃ কৃষ্ণানন্দ গঙ্গার দিকে কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর এক শ্যামাঙ্গিনী গোপকুমারীকে দেখতে পান। ঐ গোপকুমারী অপরূপ ভঙ্গীতে দণ পদ কুটিরের বারান্দার উপরে এবং বামপদ ভূতলে দিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন। তিনি একতাল গোময়যুক্ত দক্ষিণ করতল এমনভাবে উচু করে ধরেছিলেন যা দেখে বরাভয় মুদ্রার মত মনে হয়েছিল। বাম হসত্ম দিয়ে তিনি কুটিরের দেয়ালে মাটির প্রলেপ দিচ্ছিলেন। তিনি ক্ষুদ্র পরিসরে একটি শাড়ি পড়ে ছিলেন। তাই কৃষ্ণানন্দকে দেখে তিনি লজ্জায় জিব্ কেটেছিলেন। তাঁর এরকম ভঙ্গী দেখে কৃষ্ণানন্দের মায়ের প্রত্যাদেশের কথা মনে পড়ে গেল। তারপরই তিনি মায়ের ঐরকম মূর্তি রচনা করে পূজার প্রচলন করলেন। তিনি তন্ত্রসার ও শ্রীতত্ত্ববোধিনী নামক দুখানা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যা তৎকালীন পণ্ডিতবর্গের নিকট সমাদ্রিত হয়েছিল এবং অদ্যাবধি ঐ গ্রন্থ-দুখানা তান্ত্রিক তথা সকল সাধকের নিকট আদরণীয়।

ত্রৈলঙ্গ স্বামী
আনুমানিক ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে অন্ধ্রদেশের ভিজিয়ানাগ্রামে নরসিংহ রাও নামক এক ভূম্যধিকারীর ঔরসে এবং বিদ্যাবতীর গর্ভে সাধক ত্রৈলঙ্গ স্বামী জন্মগ্রহণ করে। শিবের কৃপায় জন্ম বলে নবজাতকের নাম রাখা হল শিবরাম। শিবরাম ছেলেবেলায় গম্ভীর, শান্ত ও উদাসীন প্রকৃতির ছিলেন। পিতামাতার মৃত্যুর পর পৈত্রিক সম্পত্তি অনুজ শ্রীধরকে দিয়ে শিবরাম গ্রামের শ্মশানের এক পাশে একটি কুটির তৈরি করে সাধনা করা শুরু করেন। তাঁর বয়স যখন ৭৮ তখন সহসা সেখানে ভগীরথানন্দ সরস্বতী নামক এক যোগী সন্ন্যাসী আবির্ভূত হন। শিবরাম ঐ যোগীর সাথে ঐ স্থান ত্যাগ করে পুষ্কর তীর্থে এসে তাঁর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সন্নাস গ্রহণ করার পর তাঁর নাম হয় গণপতি সরস্বতী। তবে তিনি তেলঙ্গ দেশ হতে আগত বলে কাশীর ভক্তগণের নিকট তিনি ত্রৈলঙ্গস্বামী নামে পরিচিত হন। ত্রৈলঙ্গ স্বামী গুরম্নর আশ্রয়ে থেকে রাজযোগ, হঠযোগ, লয়যোগ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার যোগ শিক্ষালাভ করেন। ত্রৈলঙ্গস্বামী সমগ্র জীবন ধরে যে কত অলৌকিক লীলা করেছেন তা বলে শেষ করা যায় না। একবার তিনি সেতুবন্ধ রামেশ্বরধামের নিকটে একটি মেলায় উপস্থিত হয়ে দেখেন এক ব্রাহ্মণকুমার প্রাণত্যাগ করেছেন। তিনি তখন তাঁর কমণ্ডলু হতে জল ছিটিয়ে দিলে ঐ ব্রাহ্মণকুমার প্রাণ ফিরে পান। এছাড়াও তিনি হিমালয়ের পাদদেশে বসবাসকারী এক বালকের শবদেহে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন। একবার এক জন্মবধির কুষ্ঠ রোগীকে এবং আরেকবার এক যক্ষ্মা রোগীকে রোগমুক্ত করেন। এক মহিলার স্বামী সর্প দংশনে মারা গেলে তিনি ঐ মৃতব্যক্তির দংশিত স্থানে গঙ্গা-মৃত্তিকা লেপন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলেন ফলে মহিলাটির বৈধব্যদশা দূর হয়। তিনি যখন নর্মদার তীরে বাস করতেন তখন একদিন নর্মদার জল দুগ্ধে পরিণত করে তা পান করেছিলেন। যোগী-ঋষিগণ কখনও সাধারণ মানুষের মত জীবন-যাপন করেন না। ত্রৈলঙ্গ স্বামী সব সময় উলঙ্গ হয়ে চলতেন। একবার আদালতে এক বৃটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তিনি মলত্যাগ করে তা ভক্ষণ করেছিলেন। অথচ উপস্থিত সবাই দেখলেন তিনি সুগন্ধিযুক্ত সুস্বাদু খাদ্য খেয়েছেন। আসলে শৈব-যোগীরা লজ্জা, ঘৃণা ও ভয়ের ঊর্ধে এবং তাঁরা চন্দন ও বিষ্ঠায় সমজ্ঞান করেন। ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ, শীত-গ্রীষ্ম প্রভৃতি কোন কিছুই যোগীদের প্রভাবিত করতে পারে না। ত্রৈলঙ্গ স্বামী যখন অজগরবৃত্তি অবলম্বন করতেন তখন নিজের ইচ্ছায় আহার সংগ্রহের চেষ্টা করতেন না। তাঁকে ভক্তরা যা খেতে দিতেন তাই তিনি তৃপ্তিভরে খেতেন। একবার এক একদল দুষ্টলোক তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য চুণগোলা জল তাঁর সামনে তুলে ধরলেন। কিন্তু তিনি তাতে রুষ্ট না হয়ে সব চুণগোলা জল অবলীলায় পান করলেন। এরপর ঐ দুষ্টলোকগুলো অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায়। স্বামীজীও তাঁদের ক্ষমা করে দেন। তিনি মা গঙ্গার তীরে থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি কখনও গঙ্গায় ডুব দিয়ে জলের নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। কখনও জলে চিৎ হয়ে ভেসে থাকতেন এমনকি তাঁকে স্রোতের বিপরীতে কোন প্রকার অঙ্গ-সঞ্চালন করেই ভেসে থাকতে দেখা যেত। একদিন মণিকর্ণিকার ঘাটে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর সাথে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাক্ষাৎ ঘটে। তখন স্বামীজী মৌনভাব অবলম্বন করেছিলেন। তাই রামকৃষ্ণদেব তাঁকে ইশারায় জীজ্ঞাসা করেছিলেন ঈশ্বর এক না অনেক। তখন তিনি ইশারাতেই বুঝিয়ে দেন- সমাধিস্থ হয়ে দেখতো-এক, নইলে যতক্ষণ আমি, তুমি, জীব, জগৎ ইত্যাদি নানা জ্ঞান থাকে ততক্ষণ ঈশ্বর অনেক। ত্রৈলঙ্গ স্বামী হিমালয়ের মানস সরোবর, নেপাল, তীববত, পুস্কর, প্রয়াগ, বারাণসী সহ বিভিন্ন তীর্থ পরিব্রাজন শেষে জীবনের শেষভাগে পঞ্চগঙ্গার ঘাটেই অবস্থান করেছেন। তিনি পঞ্চগঙ্গার ঘাটের নিকটস্থ বিভিন্ন স্থানে এবং মহেশভট্টের বাড়িতে প্রায় আশি বৎসর কাল বাস করেছেন। পরিশেষে ৩০০ বৎসর বয়স অতিক্রম করার পর ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে ডিসেম্বর (পৌষ মাসের শুক্লা-একাদশীর দিন) নিজ ইচ্ছায় ধ্যানযোগে ইহলীলা সংবরণ করেন।  

রামপ্রসাদ সেন
ঈশ্বরের শক্তিকে মাতৃরূপে সাধনার জন্য সাধক রামপ্রসাদ আজও অমর হয়ে আছেন। ১১২৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে ভাগিরথীর পূর্বতীরে অবস্থিত হুগলি শহরে শক্তিসাধক রামপ্রসাদ জন্মগ্রহণ করেন। রামপ্রসাদ ছেলেবেলা থেকেই সংসারের প্রতি অনাসক্ত ছিলেন। ২২ বছর বয়সে তাঁকে বিবাহ দেয়া হলেও সংসারের প্রতি তাঁর উদাসিনতা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। পিতার মৃত্যুর পর তিনি সংসারের হাল ধরেন। সেজন্য তিনি বাধ্য হয়ে গরানহাটার জামদার দুর্গাচরণ মিত্রের দপ্তরে মাসেক ত্রিশ টাকা বেতনে মুহুরীর কাজ শুরু করেন। কিন্তু হিসাব-নিকাশ করবেন কী, হিসাবের খাতায় তিনি শ্যামা-সঙ্গীত রচনা করতে লাগলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে জমিদার মহাশয় এসে হিসাবের খাতা খুলে দেখেন সেখানে শ্যামাসঙ্গীত লেখা। লেখার ভাব ও গভীরতা দেখে তিনি রামকে বললেন বাড়ি গিয়ে কাব্য রচনা করতে এবং তিনি আরও জানালেন যে, কাজ না করেও তিনি ত্রিশ টাকা বেতন ঠিকই পাবেন। তারপর রামপ্রসাদ গ্রামে ফিরে এসে মাতৃসাধনা ও মাতৃ-সঙ্গীত রচনায় মনোনিবেশ করলেন। একবার এক ঝড়ে তাঁর গৃহখানি ভেঙ্গে গিয়েছিল। অগত্যা তিনি নিজেই গৃহ-সংস্কারের জন্য বেড়া বাঁধতে লাগলেন। তিনি শ্যামা-সঙ্গীত গাইতে গাইতে বেড়া বাঁধতে ছিলেন আর তাঁর ছোট্ট মেয়ে বেড়ার অপর পাশ থেকে দড়ির প্রামত্ম ফিরিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ মেয়েটি স্বভাবসুলভ চপলতাবশতঃ অন্যত্র খেলতে চলে গেলেন কিন্তু তারপরও তাঁর বেড়া বাঁধায় বিঘ্ন ঘটল না। কারণ তাঁর ঐ মেয়ের মতই একটি মেয়ে তাঁকে বেড়া বাঁধায় সাহায্য করছিল। কিছুক্ষণ পর তাঁর মেয়ে এসে দেখল যে, বেড়া বাঁধার কাজ শেষের পথে। তখন মেয়েটি তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করল যে, তার অনুপস্থিতে বেড়া বাঁধার কাজ এতটা অগ্রসর হল কী করে? মেয়ের কথা শুনে রামপ্রসাদের বুঝতে আর বাকী থাকল না যে, এ কার্য স্বয়ং মা কালীরই। এরকম বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে তাঁর জীবনে। একবার রামপ্রসাদ ত্রিবেনী-ঘাটে বসে মা কালীকে গান শুনিয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে মা কালীর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। তিনি তন্ত্রোক্ত বীরাচার, দিব্যাচার, কুলাচার প্রভৃতি সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন। ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে জীবনের শেষ দিনে শক্তিসাধক রামপ্রসাদ গঙ্গার জলে নিমজ্জিত হয়ে আনন্দে মাতৃনাম গাইতে গাইতে দেহ ত্যাগ করেন। সাধক রামপ্রসাদ রচিত শ্যামাসঙ্গীত ভক্তদের হৃদয়ে আজও মাতৃভক্তি জাগ্রত করে। কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেনের মৃত্যু হলেও তাঁর রচিত শ্যামাসঙ্গীত এখনও উজ্জীবিত রয়েছে যা ভক্তদের হৃদয়ে আজও মাতৃভক্তি জাগ্রত করে।

লোকনাথ ব্রহ্মচারী
লোকনাথ ব্রহ্মচারী আনুমানিক ১১৩৮ বঙ্গাব্দের ১৮ই ভাদ্র চবিবশ পরগনা জেলার বারাসাত মহকুমার অন্তর্গত কচুয়ায় মতান্তরে উত্তর চবিবশ পরগণা জেলার চাকলা গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতা রামকানাই ঘোষাল এবং মাতা কমলাদেবীর চতুর্থ সন্তান। ভগবান গঙ্গোপাধ্যায় লোকনাথ ও তাঁর বাল্যবন্ধু বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীক্ষাও উপনয়ন সংস্কার করে তাঁদেরকে নিয়ে পরিব্রাজন করতে হিমালয়ে চলে যান। তাঁরা হিমালয় ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানে পর্যটন ও সাধনা করতে থাকেন। লোকনাথ ও বেণীমাধবের বয়স যখন ৯০ বৎসর তখন গুরু ভগবান গাঙ্গুলী তাঁদেরকে হিতলাল মিশ্রের (মতান্তরে ত্রৈলঙ্গস্বামী) নিকট সমর্পণ করে দেহত্যাগ করেন। তারপর তাঁরা গুরুর তত্ত্বাবধানে হিমালয় ও তিববতের নানা পার্বত্য স্থানে পর্যটন করেন। লোকনাথ চীন, তীব্বত ছাড়াও আরব দেশের মক্কা ও মদীনা ভ্রমণ করেন। মক্কায় তাঁর সাথে আব্দুল গফুর নামক এক ফকিরের সাক্ষাৎ হয়। লোকনাথের ভাষ্যমতে যোগ-সিদ্ধ পুরুষ আব্দুল গফুরের বয়স ছিল ৪০০ বৎসর। লোকনাথ ভক্তদের বলতেন যে তিনি তিন জন ব্রাহ্মণ দেখেছেন-একজন ত্রৈলঙ্গ স্বামী, একজন মক্কার আব্দুল গফুর এবং আরেকজন তিনি নিজে। এভাবে বহুকাল কেটে যাওয়ার পর গুরু তাঁদের লোকালয়ে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তারপর তাঁরা হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল হতে বালাদেশে আসেন। আসামে আসার পর দুই সতীর্থের চিরতরে বিচ্ছেদ ঘটে। বেণীমাধব কামাখ্যা অভিমুখে যাত্রা করেন আর লোকনাথ পূর্ববঙ্গের মহাপিঠ চন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে রওনা হন। লোকনাথ চন্দ্রনাথে বেশ কিছুকাল সাধনা করার পর ভেঙ্গু কর্মকার নামক এক ভক্ত তাঁকে বারদীতে নিয়ে আসেন। সেখানেই স্থানীয় জমিদার ও ভক্তদের সহায়তায় তাঁর আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। বারদীতে বাবা লোকনাথ নানা অলৌকিক লীলা করতে থাকেন। তাঁর আশ্রমে লোকজন রোগমুক্তি ও বিভিন্ন বিঘ্ন লাঘব করার আশায় আসতে থাকে। বাবাও সদয় হয়ে তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। বাবার কৃপায় মৃতব্যক্তিও প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। বেশ কিছুকাল পূর্বে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী যখন চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ধ্যানস্থ হয়েছিলেন তখন সেখানে দাবানল শুরু হয়েছিল। হঠাৎ সেখানে লোকনাথ ব্রহ্মচারী উপস্থিত হয়ে তাঁকে নিরাপদ স্থানে রেখে চলে গিয়েছিলেন। সেই বিজয়কৃষ্ণ বাবার সন্ধানে বারদীতে আসলে বাবা তাঁর সাথে স্নেহের আলিঙ্গন করেন। বাবার আশীষে বিজয়কৃষ্ণ আধ্যাত্মিকতার আরও উচ্চ স্তরে উপনীত হয়েছিলেন। একবার দুই উশৃঙ্খল যুবক আশ্রমবাসীদের অনিষ্ট করার উদ্দেশ্যে আসলে একটি বাঘ গর্জন করতে করতে আশ্রমের দিকে ছুটে আসে। বাঘের ভয়ে তারা পালিয়ে যায় আর বাঘটি ছুটে এসে লোকনাথ বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়ে নিজের ভাষায় কী যেন বলতে থাকে। তখন বাবা বাঘটিকে পরম স্নেহভরে জঙ্গলে ফিরে যেতে বললে বাঘটি চলে যায়। আসলে মুক্ত-পুরুষগণ পশু ও মানুষে সমজ্ঞান করেন এমনকি তাঁরা পশুর ভাষাও বুঝতে পারেন। জীবনের শেষদিকে তিনি এক যক্ষ্মা-রোগীর প্রতি করুণা পরবশ হয়ে তার সমস্ত রোগ নিজ দেহে গ্রহণ করেন। ফলে ঐ রোগীটি সুস্থ হয়ে উঠেন এবং বাবার দেহে যক্ষ্মার লক্ষণ দেখা যায়। যখন তাঁর বয়স ১৬০ বৎসরের কাছাকাছি তখন তাঁর মনে হল ইহলীলা সাঙ্গ করার সময় হয়ে গেছে। তাই তিনি মহাপ্রয়ানের দিনটি ধার্য করে ফেললেন। দেহত্যাগের কিছুদিন পূর্বে তিনি আশ্রমের ভক্তদের বলেন মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ অগ্নিতে দগ্ধ করতে। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১৮ই জৈষ্ঠ্য আশ্রমবাসীদের দুপুরের ভোজনের পর ধ্যানযোগে ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে প্রাণ-বায়ু নিঃসরণ করেন। তিনি আজও ভক্তদের বিপদের ত্রাণকর্তা। তাঁর স্থুলদেহের মৃত্যু ঘটলেও তিনি সূক্ষ্মদেহে এসে শরণাগতদের উদ্ধার করছেন। কারণ করুণাময় লোকনাথ যে বলেছিলেন, ‘‘রণে বনে জলে জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও আমিই রক্ষা করিব’’। কারণ এমন কথা কোন জীতেন্দ্রিয়, জাতিস্মর ও মুক্তপুরুষ ব্যতীত কেই বা বলতে পারে?

ভোলানন্দ গিরি
১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দে গ্রামে সাধক ভোলানন্দ গিরি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ব্রহ্মদাস এবং মাতার নাম নন্দা দেবী। তিনি পস্তানা আশ্রমে গোলাপগিরির নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তিনি গুরুর নির্দেশে পস্তানা আশ্রম ত্যাগ করে হিমালয়ে সাধনা করতে চলে যান। হিমালয়ে সাধনাকালে তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন এক পাহাড়ী লোক তাঁকে সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন। ঐ পাহাড়ী লোকটিই তাঁর প্রথম শিষ্য হলেন। হিমালয় থেকে তিনি তিববত, ওশেনিয়া, সাইবেরিয়া ও ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিব্রাজন করেন। পরে তিনি হরিদ্বারের তালতারাবাগে শাস্ত্র অধ্যয়ন ও সাধনার জন্য একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন যা ভোলাগিরি আশ্রম নামে পরিচিত হয়। তিনি যখন নবীন সন্ন্যাসী ছিলেন তখন তাঁর সাথে এক প্রবীন সন্ন্যাসীর সাক্ষাৎ হয়। তিনি দেখলেন যে, তর্পণ শেষে ঐ প্রবীন সন্ন্যাসী ‘‘গর্দভোহহম (আমিই গাধা), বিড়ালোহহম (আমিই বিড়াল), কুক্কুটোহহম (আমিই মুরগী)’’ প্রভৃতি বলছেন। এসব শুনে স্বামীজী আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাঁকে জীজ্ঞাসা করলেন, ‘‘মহারাজ, আপনি শিবোহহম না বলে এসব কী বলছেন? তখন ঐ প্রবীন সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন,‘‘বেটা অদ্বৈতভাবে উপাসনা করতে গিয়ে তোমরা দ্বৈতভাবকেই টেনে আন। ‘‘শিবোহহম’’ বলতে গিয়ে নিজেকে জীব থেকে পৃথক মনে কর। এতে ধারণা হয়, তুমি শুধু শিব, জীব নও। প্রকৃত জ্ঞানী সর্বভূতেই নিজের আত্মাকে দেখতে পান। তিনি জানেন, সবই আমি-জীব, শিব, পশু সব কিছু। মনে রাখবে, সর্বভূতে সর্বলোকে এই আত্মা বিরাজিত। সর্বস্থানে ওতপ্রোত আছে তোমার স্বরূপ, তোমার আত্মা। এই জ্ঞানই চরম অদ্বৈত জ্ঞান’’। ব্রহ্মজ্ঞ সন্ন্যাসীর কথায় তিনি পরম তপ্তি পেলেন। একবার প্রয়াগক্ষেত্রে পূর্ণকুম্ভ মেলায় ভোলানন্দের সাথে প্রভূপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সাক্ষাৎ হয়। ভোলানন্দ গিরি বিজয়কৃষ্ণকে খুব ভালবাসতেন এবং ‘‘মেরে আশুতোষ’’ বলে সম্বোধন করতেন। বিজয়কৃষ্ণ ভোলানন্দ গিরিকে সাক্ষাৎ শিব রূপে জানতেন। ভোলানন্দ গিরি একবার শ্রীহট্টের সুনামগঞ্জ নিবাসী শিষ্য অমরনাথের পুত্রকে দুরারোগ্য ব্যাধি হতে মুক্ত করেন। আরেকবার তিনি এক বাঙ্গালী শিষ্যকে অলৌকিক উপায়ে জঙ্গলে বাঘের কবল হতে রক্ষা করেন। একদিন তিনি শিবের স্বপ্নাদেশ পেয়ে আশ্রমের এক প্রামেত্ম মাটি খনন করেন। খননের ফলে শিবলিঙ্গ উঠে আসে। তিনি ঐ শিবলিঙ্গ আশ্রমে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হঠাৎ দৃষ্টিহীন হয়ে গেলে শিষ্য তাঁকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কিছুদিন পর তিনি আশ্রমে বসে ধ্যানস্থ হওয়ার পর শুনতে পান-‘‘ভোলা চেয়ে দেখ আমরা কে?’’ চোখ মেলে তিনি দেখেন তাঁর সামনে হর-পার্বতী। তখন শিব তাঁর একটি চক্ষু দান করে চলে গেলেন। এরকম অসংখ্য লীলা সাঙ্গ করে ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই মে কৃষ্ণ-চতুর্দশীতে সাধক ভোলানন্দ গিরি ইহলোক ত্যাগ করেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার কামারপুকুর গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা চন্দ্রমণি দেবীর চতুর্থ ও শেষ সন্তান। শ্রীরামকৃষ্ণের ছেলেবেলার নাম ছিল গদাধর চট্টোপাধ্যায়। গদাধরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর পর্যন্ত না হলেও বিভিন্ন উপায়ে তাঁর বেদামত্ম ও পুরাণ-শাস্ত্রীয় জ্ঞান অর্জিত হয়। ছেলেবেলায় তিনি গান-বাজনা ও যাত্রাভিনয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার লক্ষণ দেখা যায়। ছেলেবেলায় একবার তিনি ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে চলার সময় আকাশে কাল-মেঘের ফাঁকে হংস-বলাকা দেখে ভাবতন্ময় হয়ে পড়েছিলেন। এছাড়াও একবার বিশালাক্ষী দেবীর পূজার সময় এবং আরেকবার শিবরাত্রিতে অনুষ্ঠিত যাত্রায় শিবের চরিত্রে অভিনয়কালে ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে দাদা রামকুমারকে পৌরহিত্য কার্যে সহায়তার জন্য কলকাতায় আসেন। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে রাণী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রাণী রাসমণি ছিলেন জমিদার মথুরামোহন বিশ্বাসের পত্নী। নিম্নবর্ণীয়া হলেও তিনি ছিলেন ধর্মশীলা ও সতী-সাদ্ধী নারী। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কালীবাড়িতে রামকুমার পুরোহিতের দ্বায়িত্ব পান। রামকৃষ্ণ ও তাঁর ভাগনেয় হৃদয়রাম ছিলেন তাঁর সহকারী। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে রামকুমারের মৃত্যু ঘটলে গদাধর ঐ মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত হন। গদাধর মন্দিরে মাতা কালীর চরণে নিজেকে সমর্পণ করেন। তিনি তন্ত্র-মন্ত্র আর নিয়ম-অনুশাসনের ঊর্ধে গিয়ে মাতৃভাবে মা কালীর পূজা করতে থাকেন। তিনি মৃন্ময়ী দেবীকে সাধনার দ্বারা চিন্ময়ী করেছিলেন। তিনি এমনই এক পাগল ছিলেন যিনি মা কালীর নৈবেদ্য নিজে খেতেন এবং মাকেও খাইয়ে দিতেন। একদিন মন্দিরে বসে তিনি সংকল্প করলেন যে, মা কালীর দর্শন না পেলে আত্মহত্যা করবেন। ঐ মানসে মাকে অনেক ডাকার পরেও মা দেখা না দিলে তিনি মন্দিরে রাখা এক খড়গ দিয়ে নিজেই নিজের গলায় কোপ বসাতে গেলে মা নিজ রূপে দর্শন দেন। রাণী রাসমণি ও ভক্তরা এরকম নানা অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করতেন। অনেক লোক তাঁর ঐশী-শক্তি বুঝতে না পেরে তাঁকে পাগল মনে করতেন। সংসারে উদাসিনতার কারণে মা চিমত্মামণিদেবী গদাধরকে বিবাহ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিবাহের কথা শুনে গদাধর নিজেই পাত্রীর সন্ধান দিলেন। অবশেষে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর কথামত কামারপুকুরের তিন মাইল উত্তরে অবন্থিত জয়রামবাটী গ্রামের পঞ্চমবর্ষীয়া সারদা মুখোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়। সাধারণ গৃহস্থের মত গদাধরের সংসার-ধর্ম হয়নি। অর্থাৎ বিবাহের পরেও তাঁর ব্রহ্মচর্য অক্ষুন্ন ছিল। মা সারদাও ভক্তদের নিকট জগজ্জননী রূপে পূজিতা হতে থাকেন। যা হোক, গদাধর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ভৈরবী নামক এক তন্ত্রসিদ্ধা ও শাস্ত্রজ্ঞা যোগিনীর নিকট তান্ত্রিক দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ভৈরবী প্রদর্শিত পথে ৬৪ প্রকার তন্ত্র-সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন। তিনি তন্ত্রোক্ত বামাচারী হয়ে তিনি পঞ্চ ম-কারের সাধনা করেন। তবে তিনি পঞ্চ ম-কারের মদ্য ও মৈথুন বর্জন করেছিলেন। তিনি ভৈরব মতেও সাধনা করেছিলেন। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তোতাপুরি নামক এক বৈদিক নাগা-সন্ন্যাসীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তাঁর নাম হয় রামকৃষ্ণ। তিনি পরমহংস হয়েছিলেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। হিন্দুধর্ম ছাড়াও তিনি ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামী সুফি মতে এবং ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টীয় মতে সাধনা করেন। তিনি বেদ-বেদান্তের দুর্বোধ্য মতবাদগুলো সহজ করে গল্প-উপমার মাধ্যমে ভক্তদের বোঝাতেন। তিনি বলতেন- যেই কালী সেই কৃষ্ণ অর্থাৎ তিনি কালী ও কৃষ্ণতে ভেদ করতেন না। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মাধ্যমেই বেদান্তে উল্লেখিত ‘‘যত মত তত পথ’’ দর্শনের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার ঘটে। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ক্লার্জিম্যান’স থ্রোট রোগে আক্রান্ত হন যা পরবর্তীতে গলার ক্যান্সারে পরিণত হয়। কথিত আছে যে, তিনি প্রখ্যাত নাট্যকার গিরীশ চন্দ্র ঘোষের সর্ব পাপ গ্রহণ করে তাকে পুণ্যভাগ দেয়ার পর থেকেই তাঁর ঐ রোগ সৃষ্টি হয়। বাগবাজারের এই গিরীশ ঘোষই সর্ব প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে অবতার রূপে আখ্যায়িত করেছেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি কল্পতরু রূপে ভক্তের মনোষ্কামনা পূর্ণ করেন। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই আগস্ট তিনি দেহত্যাগ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ত্যাগী শিষ্যদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রজ্ঞানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ (রাখালচন্দ্র ঘোষ), স্বামী সারদানন্দ (শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী), স্বামী অভেদানন্দ (কালীপ্রসাদ চন্দ্র), স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ (শশীভূষণ চক্রবর্তী), স্বামী শিবানন্দ (তারকানাথ ঘোষাল) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

বামাক্ষেপা
সাধক বামাক্ষেপা ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে অবস্থিত তারাপীঠের নিকটস্থ মালুটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কৈলাসপতি নামক এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর স্নেহভাজন ছিলেন। কৈলাসপতির উৎসাহেই তিনি তন্ত্রসাধনা শুরু করেন এবং তারাপীঠ হয়ে ওঠে তাঁর আধ্যাত্ম-সাধনাক্ষেত্র। একদিন তারাপীঠের মন্দিরে মা তারাকে নৈবেদ্য প্রদানের পূর্বেই তিনি তা খেয়ে ফেলেছিলেন। ফলে সেখানকার পুরোহিতরা তাঁর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়েছিল। তখন মন্দির পরিচালনাকারিণী নাটোরের মহারাণীকে মা তারা তাকে আদেশ করেন যে, আগে বামাচরণকে ভোজন করিয়ে পরে তাঁকে ভোজন করাতে হবে। এরপর থেকে মায়ের আদেশ অনুসারে আগে বামাচরণকে ভোজন করানোর পর তারার ভোগ দেয়া হত। বামাক্ষেপা তারাদেবীকে মাতৃরূপে উপাসনা করেছিলেন। তারাপীঠে ভক্তরা সাধক বামাক্ষেপার নানাবিধ অলৌকিক র্কীর্তি প্রত্যক্ষ করতেন। তাঁর কৃপায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত অনেক ভক্তের রোগমুক্তি ঘটেছিল। ১৯২২ খ্রিস্টব্দে শক্তিসাধক বামাক্ষেপা দেহত্যাগ করেন।

স্বামী বিবেকানন্দ
এখন স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাক। বিবেকানন্দ ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারী কলিকাতার শিমুলিয়া অঞ্চলে এক সম্ভ্রামত্ম কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দত্ত কুলোদ্ভব বিবেকানন্দের পিতার নাম বিশ্বনাথ দত্ত এবং মাতার নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। ছেলেবেলায় তার নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। বাল্যেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার স্ফুরণ ঘটে। ছেলেবেলায় তিনি শিব, রাম, সীতা ও হনুমানের মূর্তির সামনে ধ্যানে বসতেন। তিনি ধর্মশাস্ত্র, সঙ্গীত, সাহিত্য ও শিল্পকলায় বিশেষ পাণ্ডিত্ব অর্জন করেছিলেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। প্রথম জীবনে নরেন্দ্রনাথ চরম যুক্তিবাদী থাকলেও শ্রীরামকৃষ্ণের সহচার্যে এসে তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রতিবেশী সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাক্ষাৎ পান এবং তখন তিনি তাঁকে গেয়ে শোনান সেই বিখ্যাত গান-মন চল নিজ নিকেতনে। ঈশ্বরের দর্শন লাভ সম্ভব কিনা-এই প্রশ্নের উত্তর খুজে বেড়াতেন যুক্তিবাদী নরেন্দ্রনাথ। কিন্তু ঋষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অনেকের নিকট ঐ প্রশ্নের সদোত্তর না পেয়ে তিনি চলে যান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিকট। তাঁকেও করলেন ঐ সহজ প্রশ্ন-আপনি কি ঈশ্বর দেখেছেন? শ্রীরামকৃষ্ণও সহজ ভাষায় উত্তর দিলেন- ‘‘হ্যা, আমি তোমাকে যেমন আমার সামনে দেখছি তাঁকেও ঠিক সে রকম দেখি’’। উত্তন শুনে নরেনের এত বৎসরের সঞ্চিত জ্ঞান-ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়। কিছুকাল পরে নরেন্দ্রনাথ একবার দক্ষিণেশ্বরে গেলে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে পাশে বসিয়ে দক্ষিণ চরণ তাঁর দেহে স্পর্শ করেন। তখন তাঁর মধ্যে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হতে থাকে। নরেন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন যেন বিশ্বব্রহ্মার সব কিছু তাঁর মধ্যে লয়প্রাপ্ত হচ্ছে যেমনটি অর্জুনের হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক বিশ্বরূপ দর্শনের পর। পিতার মৃত্যুর পর নরেন্দ্রনাথের সাংসারিক দুঃখ বৃদ্ধি পায় এবং সেই সাথে তাঁর আধ্যাত্মিকতাও বৃদ্ধি পায়। সংসারের কোন কিছুই তাঁকে সাধনার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সংসারের নানা অভাব-অনটনের মধ্যেও চলতে থাকে তাঁর আধ্যাত্ম-সাধনা। গুরুর কৃপায় কাশীপুরে নরেন্দ্রনাথ নির্বিকল্প সমাধী লাভ করেন। তারপর তিনি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিকট গৈরিক বস্ত্র ও সন্ন্যাস লাভ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দেহত্যাগের পর তিনিই ভক্তদের মধ্যমণি হয়ে উঠেন। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ভক্তরা চাঁদা তুলে অর্থ সংগ্রহ করে স্বামীজীকে অ্যামেরিকায় পাঠান শিকাগো বিশ্বধর্ম-মহাসম্মেলনে অংশ নিতে। তিনি ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউট হলে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম-মহাসম্মেলনে হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি বক্তৃতার শুরুতেই ‘‘আমার প্রিয় অ্যামেরিকার ভ্রাতা ও ভগিনীগণ’’ বলে সম্বোধন করলে উপস্থিত জনতার করতালী ও হর্ষধ্বনীতে মুখরিত হয়ে উঠে সভাস্থল। বৃটিশ শাসনামলে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বিশ্ববাসীর অস্পষ্ট ও নেতিবাচক ধারণা ছিল। তাছাড়া ঐ ধর্ম-মহাসম্মেলনের উদ্দেশ্যই ছিল বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা করে খ্রীস্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা। স্বামীজীর বক্তৃতার পর তা আর সম্ভব হয়নি বরং হিন্দুধর্মেরই জয়ধ্বনি হয়েছে। তিনি উক্ত ধর্ম-মহাসম্মেলনে বক্তৃতা ছাড়াও অ্যামেরিকার ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়ে বিশ্ববাসীর নিকট হিন্দুধর্মের মহিমা প্রচার করেছিলেন। তিনি বেদামত্ম চর্চা ও প্রচারের জন্য ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কে বেদান্ত সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। মিসেস ওলিবুল, জোসেফিন ম্যাকলিয়োড, ম্যাডাম মেরী লুই, মিস ডেট্রয়েটেড ক্রিস্টিনা।  ড. লিয়োন ল্যান্ডস্-বার্গ, উইলিয়াম জেমস, জোসাই রয়েস, রবার্ট ডি ইঙ্গারসোল, নিকোলা টেসলা, লর্ড কেলভিন, হ্যারিয়েট মনরো, এলা হুইলার উইলকক্স, মি. ওয়াল্ডো গুডউইল, মি. লিগেট, মেরী ফিলিপ, মিসেস আর্থার, মিসেস গুডইয়ার, সারাহ বার্নহার্ডট, এমা কেলডি, হারম্যান লুডউইক, মি. স্ট্যাডি, সোভিয়ার দম্পত্তি প্রমুখ অ্যামেরিকা ও ইংল্যান্ডের ব্যক্তিবর্গ স্বামীজীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বিদেশী শিষ্যদের মধ্যে আয়ারল্যান্ডের মিস মার্গারেট নোবেল (ভগিনী নিবেদিতা) স্বামীজীর খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন যিনি ভারতবর্ষে এসে আধ্যত্ম-সাধনা ও জীবসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। স্বামীজী শুধু বেদান্ত প্রচারই নয়, বেদান্ত-দর্শনের ব্যবহারিক প্রয়োগ করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। তবে তিনি বেদান্তবাদী হলেও মা কালীর প্রতি তাঁর অচলা ভক্তি অটুট ছিল। তিনি ভক্তদের বোঝাতেন, শুধু আচার-অনুষ্ঠানের দ্বারাই নয় জীবসেবার দ্বারাও ঈশ্বরকে লাভ করা যায়। সর্বজীবেই ঈশ্বর বিরাজ করেন বলে জীবকে সেবা করলে ঈশ্বরকেই সেবা করা হয়। তাইতো তিনি সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিয়েছেন সে অমর বাণী-‘‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসু, ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, বাল গঙ্গাধর তিলক, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, রোম্যারোলা প্রমুখ মনীশীগণ স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। তিনি জীবসেবা ও ধর্মচর্চার নিমিত্ত ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের পহেলা মে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেন যা পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ায় স্থাপিত বেলুড় মঠ কর্তৃক পরিচালিত হয়। স্বামীজী সংক্ষিপ্ত জীবনের বৃহৎ কর্মযজ্ঞ শেষে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জুলাই মহাসমাধীযোগে ইহলীলা সংবরণ করেন।

কোন মন্তব্য নেই

Akash Bairagi. Blogger দ্বারা পরিচালিত.