Header Ads

সরস্বতী দেবী ও সরস্বতী পূজা

সরস্বতী দেবী

দেবী সরস্বতী জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার দেবী। ঋগ্বেদে তিনি বৈদিক সরস্বতী নদীর অভিন্ন এক রূপ। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব, সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী। পণ্ডিতরা অনেকেই মনে করেন যে সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী পরে হলেন দেবী। এ বিষয়ে রমেশ চন্দ্র দত্ত লিখেছেন, "আর্য্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে তাই প্রথমে দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন।" বর্তমানে গঙ্গা যেমন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য দেবী হিসেবে পূজা পেয়ে থাকেন, তেমনি সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী।

সরস্বতী দেবী ও সরস্বতী পূজা

সরস্বতী দেবীর স্বরূপ

সরস্বতীর প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতী। তিনি বিদ্যাদেবী, জ্ঞানদায়িনী, বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পলাশপ্রিয়া প্রভৃতি নামে অভিহিতা। কখনো তিনি দ্বিভূজা, কখনো আবার চতুর্ভূজা। দ্বিভূজা রূপে তাঁর এক হাতে বীণা অন্য হাতে পুস্তক। চতুর্ভূজা রূপে মা বীণা বাদিনী, অক্ষমালা ও পুস্তকধারিনী।

সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ বা ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন এ ধরাতে। কালের বিবর্তনে সরস্বতী তাঁর অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞান ও ললিতকলার দেবীতে পরিণত হলেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে গোলোকে বিষ্ণুর তিন পত্নী লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যে বিবাদের ফলে গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতীর নদী রূপ পাওয়াই হচ্ছে সরস্বতীর পৃথিবীতে দেবীরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তত্ত্ব।

সরস্বতী দেবীর বাহন

সরস্বতী দেবীর বাহন হাঁস। পণ্ডিত কলহনের মতে, "সরস্বতী দেবী হংসের রূপ ধারণ করে ভেড়গিরি শৃঙ্গে দেখা দিয়েছিলেন। এ ধরনের ধারণা সঙ্গত কারণ হংসবাহনা সরস্বতীর। কথিত আছে দেবী এ বাহন ব্রহ্মার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তবে সরস্বতী দেবীর বাহন কিন্তু পাখি নয়। বেদ এবং উপনিষদে হংস শব্দের অর্থ সূর্য। সূর্যে সৃজনী শক্তির বিগ্রহাম্বিতরূপ ব্রহ্মা এবং সূর্যাগ্নির গতিশীল কিরণরূপা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব শক্তি। তাই সরস্বতী দেবীর বাহন হংস বা সূর্য হয়েছে একেবারেই যুক্তিসঙ্গত কারণে। তবে বৈদিক সাক্ষ্য থেকেই জানা যায় সিংহ ও ময়ুর সরস্বতী দেবীর আদি বাহন ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেবী দুর্গা সরস্বতী দেবীর কাছ থেকে সিংহ কেড়ে নেন আর কার্ত্তিক কেড়ে নেন ময়ূর। পরবর্তী সময়ে সরস্বতী দেবী হংসকেই তাঁর চিরস্থায়ী বাহনের মর্যাদা দেন।

দেবী সরস্বতীর জীবরূপ হংস বাহন সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই তাঁর সমান গতি ঠিক যেমন ভাবে জ্ঞানময় পরমাত্মা সব জায়গায় বিদ্যমান। অপর দিকে রাজহংস জল ও দুধের পার্থক্য করতে সক্ষম। জল ও দুধ মিশ্রিত থাকলে হাঁস শুধু সারবস্তু দুধ বা ক্ষীরটুকু গ্রহণ করে আর জল পড়ে থাকে। জ্ঞান সাধনায় হংসের এ স্বভাব যথেষ্ঠ তাৎপর্য বহন করে। তাই বিদ্যাদেবীর বাহন হিসেবে হংসকে খুব ভালোই মানায়। হাতে বীণা ধারণ করেছেন বলেই তাঁর অপর নাম বীণাপাণি। বীণার সুর মধুর। পূজার্থী বা বিদ্যার্থীর মুখ নিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর হয় এবং জীবনও মধুর সংগীতময় হয় এ কারণেই মায়ের হাতে বীণা।

সরস্বতী পূজা

সরস্বতী পূজা বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে সনাতনী সমাজে অনুষ্ঠেয় একটি অন্যতম প্রধান উৎসব। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা আয়োজিত হয়। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। শ্রীপঞ্চমীর দিন অতি প্রত্যুষে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্র-ছাত্রীদের গৃহ ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। ধর্মপ্রাণ পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবভোজন এবং পিতৃতর্পণের প্রথাও প্রচলিত আছে। পূজা উপলক্ষে এই দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সার্বজনীন পূজামণ্ডপগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়। পূজার পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত। কোথাও কোথাও সরস্বতী পূজার পরদিন অরন্ধন পালনের প্রথা রয়েছে।

সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীন কালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াত-কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্ররা নিজ নিজ বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। তখন ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।

সরস্বতী পূজোর আগে বদরীফল খায় না সনাতনীগণ। বরইয়ের আরেক নাম বদরীফল, যা পূর্বে কেবল বদরীকাশ্রমেই পাওয়া যেত। মহামুনি ব্যাসদেব বদরীকাশ্রমে বসে ব্রহ্মসূত্র রচনা করেন। তিনি ব্রহ্মসূত্র রচনা আরম্ভ করেছিলেন শ্রীপঞ্চমীর দিন। সেদিন বেদমাতা সরস্বতীকে বদরী ফল নিবেদন করে অর্চণা করে তিনি ব্রহ্মসূত্র রচনা আরম্ভ করেন। তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়েই আমরা মা সরস্বতীকে নিবেদন করার আগে বদরীফল খাই না। প্রশ্ন হতে পারে "যদি অন্য কিছু নিবেদন করতো তাহলে কি হতো"? বদরীকাশ্রমে বদরীফল ভিন্ন অন্য কোন ফলজ বৃক্ষ ছিল না। তাই একমাত্র বদরীফলই ছিল নিবেদনীয়।

মা সরস্বতী দেবীর পূজার প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির তালিকাঃ

১) মাটিয়া সিন্দুর

২) কুল (বড়ই)

৩) ঘট ১টি ও আমের সখা ১টি ৫ পাতাসহ

৪) প্রদীপ ৫-৭টি

৫) নারিকেল ১টি (দুই দিকে বটাসহ)

৬) ধুপতি ১টি (নারিকেলের ছোবা/মালাসহ)

৭) চাইলন ১টি

৮) সরঙ্গ ১ প্রপস্থ, পাখা ১টি, শাখা একজোড়া

৯) আলতা, প্রসাধনী

১০) তিল, আতপ চাল, হরতকী

১১) পান, সুপারি

১২) ঘি, মধু, চিনি, দুধ, দই

১৩) বাতাসা, কদমা, তিলা, সন্দেশ

১৪) ফল-মূল (পরিমাণ মত)

১৫) কবরী কলার ফানা

১৬) গামছা ১টি

১৭) শাড়ী ১টি

১৮) সিঁন্দুর ১ কৌটা

১৯) ইকরা/খাগ ১টি

২০) পঞ্চশস্য, চন্দন (সাদা ও রক্ত)

২১) খাতা ও কলম

২২) ধুপ ও কর্পুর, মোমবাতী, ধুপশলাকা

২৩) দোয়াত, কলম

২৪) চিড়া, খৈয়ের উখরা, মোয়া, নাড়ু

২৫) ভোগের দ্রব্য

২৬) সুতা, পঞ্চ আবির

২৭) দুর্বা, ফুল, বেলপাতা, ধান

২৮) হোমের জন্য ৮ প্রকার খড়ি (আম, বেল, পলাশ, বট, অসত্ব, যজ্ঞ ডুমুর, পদ্ম, দেবদারু)

২৯) হোম করার জন্য বালু, পাটকাঠি ইত্যাদি ।

হিন্দুদের দেবী হয়েও বৌদ্ধ বা জৈনদের কাছ থেকেও পূজা পেয়েছেন দেবী সরস্বতী। অনেক বৌদ্ধবিহারে দেবী সরস্বতীর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। জৈনদের ২৪ জন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ষোলজন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অনন্যা মা সরস্বতী।

সরস্বতীর ধ্যান মন্ত্র

ওঁ তরুণশকলমিন্দোর্ব্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ। 

কুচভরণমিতাঙ্গী সন্নিষন্না সিতাব্জে।।

নিজকর কমলোদ্যল্লেখণী পুস্তকশ্রীঃ।

সকল বিভবসিদ্ধৌ পাতু বাগদেবতা নমঃ।।

সরস্বতী প্রণাম মন্ত্র

ওঁ সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।

বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।

ওঁ ত্বং ত্বং সরস্বতী নির্মল বরণে,

রক্তে বিভূষিত কুণ্ডল করণে।

শিরে জটা গজমোতি হার

দেবী সরস্বতী বিদ্যা দাও ভার।

লাগ্ লাগ্ বিদ্যা মোর কণ্ঠে লাগ

যাবৎ জীবৎ জীবন তাবৎ থাক।

গুরুর যশ মোর ভাগ্যে দিনে দিনে বাড়ে।

ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।

বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।

সরস্বতীর স্তবঃ

ওঁ শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা।

শ্বেতাম্ভরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা।।

শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা।

শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারব‌ভূষিতা

বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ।

পূঝিতা মুনিভি: সর্ব্বৈঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা।।

স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রীং সরস্বতীম্।

যে স্মরতি ত্রিসন্ধ্যায়ং সর্ব্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে।।

সরস্বতীর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র

ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।

বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ স্বাহা।।

এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি ওঁ সরস্বতৈ দেবৈ নমঃ।।

লেখক : সুমনানন্দ পুরী, তপোবন আশ্রম, বাংলাদেশ


 

 

1 টি মন্তব্য:

Akash Bairagi. Blogger দ্বারা পরিচালিত.