Header Ads

মা দুর্গা এবং মা দুর্গার সূক্ষ্ম তাৎপর্য

মা দুর্গা এবং মা দুর্গার সূক্ষ্ম তাৎপর্য

মা দুর্গা হলেন শক্তির স্বাসত রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। অন্যান্য দেব-দেবীগণ ব্রহ্মান্ডের হিতার্থে তাঁরই বিভিন্ন রূপের প্রকাশ মাত্র। শাস্ত্র অনুসারে মা দুর্গা ‘দূর্গতিনাশিনী’ বা সকল দুঃখ দুর্দশার বিনাশকারিনী। শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে, “দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা।” অর্থাৎ, দুর্গম নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা। আবার শ্রীশ্রী চণ্ডী অনুসারে এই দেবীই ‘নিঃশেষদেবগণশক্তি সমূহমূর্ত্যাঃ’ বা সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি।

দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।

উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।

রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।

ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।

এখানে, ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’ বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও ‘আ-কার’ ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে, মহিষাসুর নামক অসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করে স্বর্গ অধিকার করলে দেবতারা ব্রহ্মার স্মরণাপন্ন হন। ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর পুরুষের অবধ্য ছিল। ব্রহ্মা এর প্রতিকারের জন্য দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণু ও মহেশ্বরের কাছে উপস্থিত হন। এরপর সমবেত দেবতারা ক্রোধে স্বদেহ হতে তেজ নির্গত করতে আরম্ভ করেন। সকল দেবতাদের তেজে এক নারী মূর্তি তৈরী হয়। মহাদেবের তেজে মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে কটিদেশ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের আঙুল, বসুগণের তেজে হাতের আঙুল, কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দাঁত, অগ্নির তেজে ত্রিনয়ন, সন্ধ্যার তেজে ভ্রূ, বায়ুর তেজে কান এবং অন্যান্য দেবতার তেজে শিবারূপী দুর্গার সৃষ্টি হয়।

মা দুর্গা

দেবতারা তাঁকে বস্ত্র, অলংকার ও অস্ত্র দ্বারা সুসজ্জিত করেন। মহাদেব দেন ত্রিশূল, বিষ্ণু দেন চক্র, বরুণ দেন শঙ্খ, অগ্নি দেন শক্তি, বায়ু দেন ধনু ও বাণপূর্ণ তূণীর, ইন্দ্র দেন বজ্র, ঐরাবত দিলেন ঘণ্টা, যম দিলেন কালদণ্ড, বরুণ দিলেন পাশ, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, সূর্য দিলেন রশ্মি, কালক্ষ ও নির্মল চর্ম, ক্ষিরোদ সাগর দিলেন অক্ষয়বস্ত্রসহ বিভিন্ন অলঙ্কার ও আভরণ, বিশ্বকর্মা দিলেন পরশুসহ নানাবিধ অস্ত্র ও অভেদ্য কবচমালা, হিমালয় দিলেন বাহন সিংহ, কুবের দিলেন অমৃতের পান পাত্র, বাসকি নাগ দিলেন নাগহার ও অন্যান্য দেবতা তাদের সাধ্যমতো উপহার দিলেন। এভাবে তিনি হয়ে উঠলেন দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির প্রতিরূপা। এই দেবীই হলেন মা দুর্গা। দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত আদ্যাশক্তি মহামায়া অসুর কূলকে একে একে বিনাশ করে স্বর্গ তথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শান্তি স্থাপন করেন। দেবী দুর্গা ত্রি-নয়না বলে তাঁকে ‘ত্র্যম্বকে’ বলা হয়। তাঁর বাম চোখ হলো বাসনা (চন্দ্র), ডান চোখ কর্ম (সূর্য) ও কেন্দ্রীয় চোখ হলো জ্ঞান (অগ্নি)।

মা দুর্গার দশ হাতে দশ অস্ত্রের রহস্য

মা দুর্গার দশ বাহুতে যে দশটি অস্ত্র রয়েছে, সেই অস্ত্রসমূহও বিভিন্ন প্রতীকের ইঙ্গিতবাহী।

দেবী দুর্গার ত্রিশূল

মা দূর্গার হাতে ত্রিশূল অস্ত্রটিকে দেখা যায় প্রধান অস্ত্র হিসাবে। ত্রিশূল দিয়েই মা দুর্গা মহিষরূপী অসুরকে বধ করেছিলেন। এই অস্ত্র দেবাদিদেব মহাদেবের হাতে থাকে এবং ত্রিকালদণ্ড স্বরূপ এই অস্ত্র মহাদেব দেবী দূর্গাকে প্রদান করেছিলেন। শাস্ত্র মতে ত্রিশূল হল ত্রিগুনের প্রতীক। এই ত্রিগুণ হল সতঃ রজঃ তমঃ। সতঃ গুণ হল দেবগুণ। এই গুণ নিরহংকার, ত্যাগ ও উচ্চ অলৌকিকত্বের প্রকাশ করে। রজঃ গুণ হল মনুষ্য বা জীব কুলের গুণ। শোক, লোভ, মায়া, মোহ, কাম, দুঃখ দ্বারা জর্জরিত এই গুণ জীবকুলের মায়া স্বরূপ। তমঃ গুণ হল রাক্ষস বা ঋণাত্বক শক্তির প্রকাশ। সব ধ্বংসের মূল হল এই গুণ যা ক্রোধ, লোভ, মিথ্যা, বিলাসিতা, প্রতারণা, চুরী, হত্যা ইত্যাদি অপরাধমূলক কার্য উজ্জিবিত করে। এই ত্রিগুনাত্মক হল ত্রিশূল। ত্রিশূলের মধ্য ভাগের ফলাটি সতঃ গুণ ও বাকি দুই দিকে রজঃ ও তমঃ গুণ সম উচ্চতা বিশিষ্ট দুটি ফলা। মানব জীবনের লক্ষ্য হল সতঃ গুণের বিকাশ যা মুক্তির পথ। ত্রিশূল যার স্পর্শে বা স্মরণে ত্রিগুন থেকে মুক্তি লাভ হয়।

দেবী দুর্গার শঙ্খ

শঙ্খ বা শাঁখ দেবী দুর্গার বাম হাতে থাকে, যা বরুন দেব দেবীকে প্রদান করেন। শঙ্খ ‘প্রণব’ বা ওঙ্কার ধ্বনির অর্থবহতা নির্দেশ করে। সমগ্র জীব জগতের স্পন্দন স্বরূপ এই অস্ত্র দেবীর হাতে সজ্জিত থাকে। শাঁখ জাগরনেরও প্রতীক। যুদ্ধের সময় এর শব্দ যেমন শত্রুকে সতর্ক করে তেমন জাগরনী শক্তি হিসাবে কাজ করে। দেবী জগত মাতাকে আমরা পঞ্চভূতের একত্রিত শক্তি প্রকৃতি স্বরূপ মনে করি, তাই প্রান শক্তির উৎস হিসাবে তার হাতে শাঁখ থাকে।

দেবী দুর্গার চক্র

মা দুর্গাকে চক্র অস্ত্রটি প্রদান করেন ভগবান শ্রী বিষ্ণু। মায়ের ডান হাতে থাকে সুদর্শন চক্র। “সু” অর্থাৎ সুন্দর আর “দর্শন” অর্থাৎ দৃশ্যমান। সুদর্শন চক্র হল ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক স্বরূপ। যার কেন্দ্রবিন্দু থেকে সমস্থ তেজ শক্তি সঞ্চারিত বিচ্ছুরিত হয়ে চলেছে। ব্রহ্মাণ্ডও ঠিক চক্রের মতো আবর্তন করে চলেছে কোন কেন্দ্র বিন্দুকে নির্ভর করে। দেবী প্রকৃতি স্বরূপা আদ্যাশক্তি। কাল বা সময় এবং কাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ব্রহ্মাণ্ড যার ধাত্রে বিকশিত জীবজগৎ তার মধ্যবর্তী। তিনি হলেন মা দুর্গা যিনি আদ্যাশক্তির প্রকাশ।

দেবী দুর্গার খড়্গ

দেবীর ডান হস্তে খড়্গ বা খাঁড়া উদ্দত হয়ে থাকে। খড়গ দিয়ে দেবী অসুরের মস্তক ছিন্ন করে মুন্ডমালা ধারন করেছিলেন নিজের কন্ঠে। খড়গ হল বলি প্রদানের অস্ত্র। বলি হল, বিবেক বুদ্ধির মধ্যে নিহিত অশুভের নিধন যজ্ঞ। হিংসা, গ্লানি, ক্রোধ, অহংসহ ষড় রিপু থেকে নিজের আত্মশক্তিকে পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়া। তাই দেবীর হস্তে সজ্জিত খড়গ হল, পরম মোক্ষের প্রতীক। এই খড়গ সর্বদা উদ্দত অভয় প্রদানকারী এবং আত্ম নিবেদন ও ত্যাগের প্রতীক। ত্যাগ আমাদের চৈতন্য প্রদান করতে সাহায্য করে কলুস মুক্ত আত্মজ্ঞানকে। মোক্ষ হল মুক্তির পথ, যা মানব জীবনের একমাত্র অভিষ্ট। তাই খড়গ দেবীর হস্তে থাকে।

দেবী দুর্গার কালদণ্ড

গদা বা কালদণ্ড অস্ত্রটি মহিষাসুর নিধন যজ্ঞে দেবী মহামায়াকে প্রদান করেন স্বয়ং ধর্মরাজ যম। গদা বা কালদন্ড হল মহাপ্রীতি ও আনুগত্যের প্রতীক। দেব-দানব-মানব সকল শুভ ও অশুভ শক্তিই এই মহাশক্তির নিয়ন্ত্রনাধীন। তাই কালদণ্ড আমরা দেবী দুর্গার বাম হস্তে সম্মোহনকারী শক্তি হিসাবে দেখতে পাই।

দেবী দুর্গার ধনুর্বান

তীর ও ধনুক দেবী দুর্গার বাম হস্তে থাকে। পবনদেব দেবী দুর্গাকে ধনুর্বাণ প্রদান করেন। ধনুর্বাণ স্থির লক্ষ্য আর ঋণাত্বক শক্তির প্রতীক। জীবনে এমন কিছু মুহুর্ত, কিছু ঘটনাক্রম আসে যা আমাদের পরীক্ষার মুখে ফেলে দেয়। প্রতি পদক্ষেপে জীবের জীবন সে পরীক্ষা বা যুদ্ধের নামান্তর মাত্র। তাই সে যুদ্ধে জয় পেতে, স্থির লক্ষ্য ও সমস্থ ঋনাত্বক শক্তির প্রকাশ আমাদের সঠিক দিক নির্বাচন করতে সাহায্য করে। সঠিক লক্ষ্যে সঠিক পথ নির্বাচন করতে পারলেই জীবনের জটিল পরিস্থিতি থেকে পরিত্রান পাওয়া যায়। তীর ধনুক সেই কাল্পনিক লক্ষ্যভেদের অস্ত্র যা মা দূর্গার হাতে সজ্জিত থাকে আমাদের জীবনের সত্যের পথ ও লক্ষ্য নির্বাচন করতে।

দেবী দুর্গার ঘন্টা

দেবীর বাম হস্তে ঘন্টা থাকে। ঘন্টা অস্ত্রটি দেবী চন্ডিকে দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত প্রদান করেন। ঘন্টা ডঙ্কার ধ্বনি যুদ্ধের আহ্বান করে। ঘন্টা আসুরিক শক্তিকে দুর্বল করে। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে বর্নিত আছে দেবী মহিষাসুরকে যুদ্ধে আহ্বান করার সময় সতর্কবার্তা স্বরূপ দেবী অট্টহাসি হাসেন এবং শাঁখ ও ঘন্টার ধ্বনিতে তাদের যুদ্ধপ্রস্ততির নির্দেশ দেন। শব্দ এমন তরঙ্গ যার প্রভাব সুদুর প্রসারী ও বার্তা বাহক। তাই ঘন্টার ধ্বনি অস্তিত্ব প্রমান করে।

দেবী দুর্গার নাগপাশ

দেবী দুর্গার বাম হস্তের নিচের দিকে নাগপাশ থাকে যা অনন্ত নাগ মা দুর্গাকে প্রদান করেন যুদ্ধের অস্ত্র হিসাবে সুসজ্জিত করার জন্য। নাগপাশ, হচ্ছে বিশুদ্ধ চেতনার প্রতীক। দেবী যখন মহিষরূপী অসুরকে নিয়ন্ত্রন করতে ক্লান্ত তখন একমাত্র নাগপাশেই তিনি ক্ষনে ক্ষনে রূপ পরিবর্তনকারী অসুরকে আবদ্ধ করে তার কেশ বাম মুঠোয় ধরেন। আর নাগপাশে জর্জরিত অসুরের চেতনা ফিরে যে তিনি দেবীর নিকট বন্দি হয়েছেন।

দেবী দুর্গার বজ্র

বজ্রা মা দুর্গাকে প্রদান করেন দেবরাজ ইন্দ্র। দেবীর বাম হস্তে থাকে বজ্র, যা কঠোর ও সংহতির প্রতীক। আমাদের চরিত্রে ও ব্যবহারীক জীবনে কঠোরতা প্রয়োজন। আর সংহতিপূর্ণ সমাজ জীবন সব মানুষের কাম্য। তাছাড়া মায়ের হস্তে ধৃত বজ্রাগ্নি ভক্তের সঙ্কল্পের দৃঢ়তাও নির্দেশ করে।

দেবী দুর্গার পদ্ম, অক্ষমালা ও কমন্ডলু

দেবী দুর্গাকে পদ্ম, অক্ষমালা ও কমন্ডলু প্রদান করেন প্রজাপ্রতি ব্রহ্মা। পদ্ম পাঁকে জন্মায় তবুও সে পবিত্র। সেরকম অন্ধকার থেকে আলোতে উত্তরনের পথের প্রতীক হল পদ্ম। জীব জগৎ সৃষ্টির সঙ্গে প্রস্ফুটিত পদ্মের তুলনা করা হয়েছে। সমস্থ দেবদেবীদের অধিষ্ঠান প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর। সর্ব শক্তির আধারও এ পদ্ম। এছাড়া দেবীর দক্ষিণ হস্তে থাকা অক্ষমালা ও কমন্ডলু হচ্ছে পবিত্রতার প্রতীক।

মা দুর্গার কাঠামো

'দুর্গা' এই নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দেবীমূর্তি, যার এক পা সিংহের পিঠে, আর এক পা অসুরের কাঁধে। তাকে ঘিরে থাকেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর কার্তিক।

গণেশ

কার্যসিদ্ধির দেবতা গণেশ। পুরাণ অনুসারে, সকল দেবতার পূর্বে গণেশের পূজা করতে হয়। গণেশের পূজা না করে অন্য দেবতার পূজা করা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। গণশক্তি যেখানে ঐক্যবদ্ধ সেখানে কর্মের সকল প্রকার বাঁধাবিঘ্ন দূরীভূত হয়। দেবাসুর-যুদ্ধে দেবতারা যতবারই ঐক্যবদ্ধ হয়ে অসুরদের সঙ্গে লড়াই করেছেন ততবারই তাঁরা জয়ী হয়েছেন। গণেশের অপর এক নাম বিঘ্নেশ, অর্থাৎ বিঘ্ননাশকারী। বিঘ্নেশ প্রসন্ন থাকলে সিদ্ধি নিশ্চিত। গণেশের বাহন মূষিক বা ইঁদুর। ইঁদুর মায়া ও অষ্টপাশ ছেদনের প্রতীক। অথর্বশীর্ষের সায়নভাষ্যে উক্ত হয়েছে "মুষ্ণাতি অপহরতি কর্মফলানি ইতি মূষিকঃ"। জীবের কর্মফলসমূহ অজ্ঞাতসারে অপহরণ করে বলিয়া ইহার নাম মূষিক। প্রবল প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ কর্মফল বিদ্যমান থাকতে সিদ্ধিলাভ হয় না। তাই, কর্মফল হরণের উপর সিদ্ধি প্রতিষ্ঠিত।

লক্ষ্মী

শ্রী, সমৃদ্ধি, বিকাশ ও অভ্যুদয়ের প্রতীক লক্ষ্মী। শুধু ধনৈশ্বর্যই নয়, লক্ষ্মী চরিত্রধনেরও প্রতীক। ধন, জ্ঞান ও শীল এই তিনেরই মহনীয় বিকাশ দেবী লক্ষ্মীর চরিত্র মাহাত্ম্যে। সর্বাত্মক বিকাশের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা বলেই তিনি কমলা। কমল বা পদ্মের ন্যায়ই তিনি সুন্দরী। তদীয় নেত্রদ্বয় পদ্মের ন্যায় আয়ত। তাঁর শুভ করে প্রস্ফুটিত পদ্মকুসুম; পদ্মবনেই তাঁর বসতি। দেবী লক্ষ্মীর বাহন পেচক বা প্যাঁচা। রূপে ও গুণে অতুলনীয় এই দেবীর এমন কিম্ভূতকিমাকার বাহন কেন? সে নিয়ে বেশ কয়েকটি মত প্রচলিত আছে। প্রথমেই স্মরণে রাখা কর্তব্য, শাস্ত্রে কোথাও পেচককে দেবী লক্ষ্মীর বাহনের মর্যাদা প্রদান করা হয়নি। এই বিশ্বাস একান্তই বাঙালি লোকবিশ্বাস। প্যাঁচা দিবান্ধ। মনে করা হয়, যাঁরা দিবান্ধ অর্থাৎ তত্ত্ববিষয়ে অজ্ঞ, তাঁরাই পেচকধর্মী। মানুষ যতকাল পেচকধর্মী থাকে ততদিনই ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করে সে। তাছাড়া মুক্তিকামী সাধককেও পেচক বলে। সকলে যখন ঘুমায় তুমি আমার মতো জাগিয়া থাক, আর সকলে যখন জাগ্রত তখন তুমি আমার মতো ঘুমাইতে শিখ, তবেই হবে সাধনে সিদ্ধি ও কৈবল্যধন লাভ। পরমার্থ ধনাভিলাষী সাধক পেঁচার মতো রাত্রি জেগে সাধন করে। লোকচক্ষুর অন্তরালে নির্জনে থাকে। লক্ষ্মী মায়ের বাহন রূপে আসন লইয়া পেচকের যে ভাষণ তাহা বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন প্রকার সাধকের উপাদেয় সম্পদ।

সরস্বতী

বাণীরূপিণী বাগদেবী সরস্বতী। তিনি জ্ঞানশক্তির প্রতীক। দেবীর হাতে পুস্তক ও বীণা। পুস্তক বেদ শব্দব্রহ্ম, আর বীণা সুরছন্দের প্রতীক নাদব্রহ্ম। তিনি শুদ্ধ সত্ত্বগুণের পূর্তি, তাই সর্বশুক্লা। শ্বেতবর্ণটি প্রকাশাত্মক। সরস্বতী শুদ্ধ জ্ঞানময়ী প্রকাশস্বরূপা। জ্ঞানের সাধক হতে হলে সাধককে হতে হবে দেহে মনে প্রাণে শুভ্র-শুচি। দেবী সরস্বতীর বাহন হংস। হংস সনাতনীদের নিকট একটি পবিত্র প্রতীক। দেবী সরস্বতী-ব্রহ্মবিদ্যা স্বরূপিনী। যে সাধক দিবারাত্র অজপা মন্ত্রে সিদ্ধ তিনিই হংসধর্মী। মানুষ সুস্থ শরীরে দিবারাত্র মধ্যে একুশ হাজার ছয়শত বার ‘হংস’ এই অজপা মন্ত্র জপরূপে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে থাকে। মানুষ যতদিন এই স্বাভাবিক জপ উপলব্ধি করতে না পারে, ততদিন ‘হংসধর্মী’ হতে পারে না; সুতরাং ব্রহ্মবিদ্যারও সন্ধান পায় না। হংসের অপর গুণ হলে জল ও দুধের মিশ্রন থেকে সে শুধু দুধটুকুই গ্রহণ করে। সাধককে সে শিক্ষা দিচ্ছে জগতের গড়ল ফেলে অমৃতই গ্রহণ কর।

কার্তিক

দেবসেনাপতি কার্তিকেয় বা কার্তিক সৌন্দর্য ও শৌর্যবীর্যের প্রতীক। যুদ্ধে শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন একান্ত প্রয়োজনীয়। তাই সাধন জীবনে এবং ব্যবহারিক জীবনে কার্তিকেয়কে প্রসন্ন করতে পারলে শৌর্য-বীর্য তাদের করতলগত হয়। কার্তিকেয়ের বাহন ময়ূর। সৌন্দর্য ও শৌর্য কার্তিকেয়ের এই দুই বৈশিষ্ট্যই তাঁর বাহন ময়ূরের মধ্যে বিদ্যমান।

দুর্গার বাহন সিংহ

মা দুর্গার বাহন সিংহ। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে সিংহকে মহাসিংহ, বাহনকেশরী, ধূতসট ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। দুর্গাপূজার সময় সিংহকেও বিশেষভাবে পূজা করা হয়। দেবীপুরানে উল্লিখিত সিংহের ধ্যানে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিষ্ণু, শিব, দুর্গা প্রমুখ দেবদেবীরা অবস্থান করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি ধ্যান মন্ত্রে সিংহকে বিষ্ণুর রূপও বলা হয়েছে। তাছাড়া কালীবিলাস তন্ত্রে মা দুর্গার বাহনকে বলা হয়েছে বিষ্ণুরূপী সিংহ। কালিকাপুরাণ অনুসারে, দুর্গার বাহন হওয়ার জন্য শিব শবদেহ, ব্রহ্মা রক্তপদ্ম ও বিষ্ণু সিংহের মূর্তি ধারণ করেছিলেন। দেবীপুরাণ অনুযায়ী, বিষ্ণু দুর্গার বাহন সিংহকে নির্মাণ করেছিলেন এবং সেই সিংহে সকল দেবতার অধিষ্ঠান হয়েছিল। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে, হিমালয় মা দুর্গাকে বাহনরূপে সিংহ দেন। শিবপুরাণ অনুসারে, শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গাকে সিংহ দেন। পদ্মপুরানে আছে, দুর্গার ক্রোধ থেকে সিংহের জন্ম হয়। সিংহ রজোগুণের এক প্রচণ্ড শক্তির উচ্ছ্বাসের প্রতীক। সত্ত্বগুণের অনুগত হলে আসুরিক শক্তিও লোকস্থিতির সহায়ক হয়ে ওঠে। সিংহ আসুরিকতা ও পাশবিকতার উচ্ছেদ সাধনপূর্বক দেবীর লোকস্থিতিমূলক পূণ্য কর্মের সহায়তাকারী। সিংহ মানুষের পশুত্ববিজয়েরও প্রতীক। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে পশুশক্তি। সাধন-ভজনের দ্বারা মানুষ যখন যথার্থ মনুষ্যত্বে উপনীত হয় তখন তার পশুভাব কেটে গিয়ে দেবভাব জাগ্রত হয়। আর তখনই সে প্রকৃত শরণাগত হওয়ার যোগ্যতা লাভ করে, স্বার্থক জীবনের অধিকারী হয়। দেবীর চরণতলে সিংহ সেই ভাবেরই প্রতীক।

নবপত্রিকা

দূর্গা পূজার কাঠামোতে একটি রহস্যময় বিষয় হলো নবপত্রিকা। পত্রিকা শব্দের অর্থ পাতা হলেও আসলে নবপত্রিকা হলো নয়টি মূল ও পাতাসহ গাছ। মূলত ‘শাকম্ভরী’ মূর্তিকল্পনার আড়ালে নবপত্রিকার পূজো। কৃষিভিত্তিক সমাজ গঠনের পর্বে শস্যদায়িনী ধরিত্রী মাতার আরাধনাই প্রকৃতপক্ষে নবপত্রিকার পূজো। পুরাণসূত্র অনুসারে দেবীর ৯টি রূপ এবং সেগুলির প্রতীক হিসাবে ৯টি বিভিন্ন গাছের ডাল বা অংশ নিয়ে গড়া হয় ‘নবপত্রিকা’। এতে লাগে১) কদলী, রম্ভা বা কলা গাছ ২) কৃষ্ণ কচু বা কালো কচু গাছ ৩) হরিদ্রা বা হলুদ গাছ ৪) জয়ন্তী গাছ ৫) বিল্ব বা বেল গাছ ৬) দাড়িম্ব বা ডালিম গাছ ৭) অশোক গাছ ৮) মানকচু গাছ ৯) ধান্য বা ধান গাছ।

গণেশের ডান পাশে স্থাপিত নবপত্রিকা একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি মূল ও পত্রসহ উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেলসহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবী প্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলাবউ।

নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়। এই নয় দেবী হলেন- রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী। এই নয় দেবী একত্রে "নবপত্রিকা বাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ" মন্ত্রে পূজিতা হন।

শিব

সনাতন ধর্মের শাস্ত্রসমূহে শিব পরমসত্ত্বা রূপে ঘোষিত। শিব সৃষ্টি-স্থিতি-লয়রূপ তিন কারণের কারণ, পরমেশ্বর- এটা তাঁর প্রণাম মন্ত্রেই বার বার উঠে এসেছে। তিনি জন্মরহিত, শাশ্বত, সর্বকারণের কারণ; তিনি স্ব-রূপে বর্তমান, সমস্ত জ্যোতির জ্যোতি; তিনি তুরীয়, অন্ধকারের অতীত, আদি ও অন্তবিহীন। এছাড়াও বেদান্ত অনুসারে তিনিই ঈশ্বর। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে- "যদাহতমস্তুন্ন দিবা ন রাত্রির্নসন্ন চাসচ্ছিব এব কেবলঃ।" অর্থাৎ যখন আলো ছিল না, অন্ধকারও ছিল না; দিন ছিল না, রাত্রিও ছিল না; সৎ ছিল না, অসৎ ও ছিল না- তখন কেবলমাত্র ঈশ্বর শিবই ছিলেন। সম্পূর্ণ বেদান্তে শিব ব্যতীত কারো সম্পর্কে এভাবে বলা হয়নি। শুধুমাত্র শিবের ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে "শিব এব কেবলঃ"। সুতরাং সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র শিবই বর্তমান ছিলেন। তিনিই লীলাচ্ছলে ব্রহ্মারূপে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপ ধারণ করে পালন করেন আবার রুদ্ররূপ ধারন করে সংহার করেন। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-হর তাঁরই সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের তিনটি রূপভেদ মাত্র। তাই এই তিন রূপের মধ্যে সত্বার কোন পার্থক্য নেই। তবু সনাতন রূপ পরম শিবরূপই মূলস্বরূপ।

অসুর

মহিষাসুর দেবদ্রোহী, তাই সে দেবী প্রতিমায় দেবীর পদতলে দলিত। এই অসুর ‘সু’ এবং ‘কু’-এর মধ্যকার চিরকালীন দ্বন্দে অশুভ শক্তির উপর শুভশক্তির বিজয়ের প্রতীক। তবে অসুর হলেও দুর্গোৎসবে মহিষাসুরেরও পূজার চলে আছে। কালিকা পুরাণ অনুসারে, মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে নিজের মৃত্যুদৃশ্য স্বপ্নে দেখে ভীত মহিষাসুর ভদ্রকালীকে তুষ্ট করেছিলেন। ভদ্রকালী তাঁকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি না দিলেও তাঁর ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে বরদান করতে ইচ্ছুক হন। মহিষাসুর দেবতাদের যজ্ঞভাগ বর চাইলে দেবী সেই বর দিতে অস্বীকৃত হন; কিন্তু মহিষাসুরকে এই বর দেন যে, যেখানেই দেবী পূজিতা হবেন, সেখানেই তাঁর চরণতলে মহিষাসুরেরও স্থান হবে। সাধারণ মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট, ভয়-ভীতি, আপদ-বিপদ এ সকলই আসুরিক শক্তির কার্য। সাধকের পক্ষে অসুর অবিদ্যা। বিদ্যারূপিণী মা অবিদ্যা বিনাশ করে মহামুক্তির বিধান করেন। পরম করুণাময়ী মা নিরন্তর অসুর বিনাশ করে সন্তানের কল্যাণ বিধান করছেন।

মা দুর্গার নাম ও রূপ রহস্য

অথর্ব বেদের দেব্যথর্বশীর্ষম এ বলা হয়েছে, সকল দেবতারা দেবীর কাছে গিয়ে বিনীত ভাবে প্রশ্ন করলেন, হে মহাদেবী! তুমি কে? উত্তরে তিনি বললেন- আমি ব্রহ্মস্বরূপ। আমার থেকেই প্রকৃতি-পুরুষাত্মক সৎরূপ ও অসৎরূপ জগৎ উৎপন্ন হয়েছে। আমিই জগতের ঈশ্বরী। ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী ও দুর্গতিনাশকারী- এই অর্থে সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরের এক নাম দুর্গা। যে দেবী অগম্যা, দুষ্প্রাপ্যা বা যাকে সহজে পাওয়া যায় না এই অর্থেও তিনি দুর্গা। দুর্গম নামক দৈত্যকে দমন করে তিনি দুর্গা নামে খ্যাত হন। মা দুর্গা পরমাপ্রকৃতিস্বরূপা মহাদেবী। মার্কণ্ডেয় পুরাণের মতে, তিনি মহামায়া, পরমবিদ্যা, নিত্যস্বরূপা, যোগনিদ্রা। তিনি জন্ম-মৃত্যু রহিতা। মহাশক্তির অধিষ্ঠাত্রী অর্থেও পরম ঈশ্বরকেই দুর্গা বলে বর্ণনা করা হয়। দেবীর দশ হাত সেই অর্থে মহাশক্তির পরিচায়ক। দুর্জন বা অসুরেরাই জগতের দুর্গতির প্রধান কারণ। আর মা দুর্গা অসুরনাশিনী নামে প্রকাশিত হয়েছেন।

শাস্ত্রে বিভিন্ন রকমের দুর্গাদেবীর কথা উল্লেখ আছে। সাধারণত সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালিরা মা দুর্গার যে মূর্তিটি শারদীয়া দুর্গোৎসবে পূজা করে থাকেন, সেই মূর্তিটির শাস্ত্রসম্মত নাম মহিষাসুর মর্দিনী। বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে মহিষাসুর মর্দিনীর একটু আলাদা রকমের বর্ণনা আমরা পাই। চণ্ডিকা নামে উল্লিখিত এই দুর্গার কুড়িটি হাত। ডান দিকের দশ হাতে থাকে যথাক্রমে- শূল, খর্গ, শঙ্খ, চক্র, বাণ, শক্তি, বজ্র, অভয়, ডমরু, ছাতা; আর বাম দিকের দশ হাতে থাকে নাগপাশ, খেটক, পরশু, অঙ্কুশ, ধনুক, ঘণ্টা, পতাকা, গদা, দর্পন ও মুগুর। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে অষ্টাদশভুজা মহালক্ষ্মীর কথা উল্লেখ আছে। দেবী কাত্যায়নীর মূর্তিটি দশভুজা দুর্গার অনুরূপ।

বর্তমানে পরিচিত মহিষাসুরমর্দিনী ও তন্ত্রকথিত মহিষাসুরমর্দিনীর রূপে সামান্য পার্থক্য দেখা যায়। দেবী মহিষাসুরমর্দিনী অষ্টভুজা। এর ধ্যানে সিংহের উল্লেখ পাওয়া যায় না। দেবীকে মহিষের মাথার উপর বসে থাকতে দেখা যায়। হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, খর্গ, খেটক, ধনুক, বাণ, শূল ও তর্জনীমুদ্রা। এর পূজার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল- শঙ্খপাত্রে অর্ঘ্য স্থাপনের উপর নিষেধাজ্ঞা; মৃৎপাত্রে এই কাজটি করতে হয়।

কুলাচারে পূজিতা দেবী জয়দুর্গার মূর্তিটি কিছুটা জগদ্ধাত্রী মূর্তির মতো। শুধু দেবীর চার হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, খর্গ ও ত্রিশূল এবং দেবীর গায়ের রং মা কালীর মতো কালো। কপালে থাকে অর্ধচন্দ্র। সিংহের পদতলে হাতি অনুপস্থিত। কেউ কেউ মনে করেন, জয়দুর্গা কালী ও দুর্গার সম্মিলিত মূর্তি।

তন্ত্র ও পুরাণে আরও কয়েকজন দুর্গা নামধারিণী দেবীর সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন- পঞ্চদুর্গা, নবদুর্গা, বনদুর্গা, অগ্নিদুর্গা, বিন্ধ্যবাসিনী দুর্গা, রিপুমারি দুর্গা, অপরাজিতা দুর্গা। শাস্ত্রে দুর্গার নয়টি নির্দিষ্ট মূর্তিকে ‘নবদুর্গা’ বলে। এঁরা হলেন- ব্রহ্মাণী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, নারসিংহী, বারাহী, ইন্দ্রাণী, চামুণ্ডা, কাত্যায়নী ও চণ্ডিকা। দুর্গাপূজার সময় দেবীদুর্গার আবরণ দেবতা হিসেবে এঁদের পূজা করা হয়।

বন দুর্গার আট হাত। অস্ত্রশস্ত্র মহিষমর্দিনীর অনুরূপ। বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেবীর গায়ের রঙ ঘাসের মতো সবুজ। অগ্নিদুর্গাও অষ্টভুজা। তার আট হাতে থাকে খর্গ, চক্র, খেটক, বাণ, পাশ, অঙ্কুশ, বরদা মুদ্রা ও তর্জনী মুদ্রা। দেবী সিংহবাহিনী, ভীষণা এবং কপালে অর্ধচন্দ্র ধারিণী। দুই পাশে ঢাল-তলোয়ার ধরে থাকেন দেবীর দুই সহচরী। বিন্ধ্যবাসিনী দুর্গা পদ্মাসনা, ত্রিনয়না ও চতুর্ভুজা। তার চার হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয় মুদ্রা। তারও কপালে অর্ধচন্দ্র। সালঙ্কারা এই দেবীকে ঘিরে স্তব করেন ইন্দ্রাদি দেবতারা। দেবীর বাহন সিংহ পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। রিপুমারি দুর্গা দ্বিভুজা। তার দুই হাতে থাকে ত্রিশূল ও তর্জনী মুদ্রা। 

তন্ত্রে দেবী দুর্গার যে দুটি রূপ বর্ণিত সে দুটি দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপ। তার একটিতে অবশ্য সিংহের পায়ের তলায় হাতি থাকে না। অপর রূপটির মন্ত্র অনুসারে জগদ্ধাত্রী পূজা হয়। মহাশক্তি বলে দুর্গাকে নিদ্রা, ক্ষুধা, লজ্জা, তুষ্টি, আগুনের দাহিকা শক্তি, সূর্যের তেজ, জলের শীতলতা, ব্রাহ্মণের ব্রহ্মণ্যশক্তি, ক্ষত্রিয়ের ক্ষত্রিয়শক্তি, তপস্বীর তপস্যাশক্তি, ক্ষমাবানের ক্ষমাশক্তি, পৃথিবীর ধারণ ও শস্য উৎপাদন ক্ষমতা প্রভৃতি বলে স্তব করা হয়েছে।

যারা শাস্ত্রতত্ত্ব বোঝেন না, তারাই মাটির দুর্গা প্রতিমাকে দুর্গা মনে করেন। কিন্তু জ্ঞানী ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি বুঝতে পারেন যে, ঈশ্বরকেই অবস্থা বিশেষে দুর্গা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। শাস্ত্র মতে, মূল প্রকৃতিকে ঈশ্বরের সৃষ্টিশক্তি বা মায়াশক্তি বলে। আবার পঞ্চভূত ইত্যাদি জড় পদার্থের সমষ্টিকেও প্রকৃতি বলে গণ্য করা হয়। দুর্গা হলেন মূল প্রকৃতি।

মা দুর্গার নয়টি রূপের কথা চন্ডিতে পাওয়া যায়। যে নয়টি রূপে ব্রহ্মা মহামায়ার ধ্যান করেছিলেন। সেগুলো হচ্ছে- শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘন্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্ধমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রী, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রী। এইগুলি হচ্ছে মায়ের নবরূপ, নবশক্তি তথা নবরাত্রি। অকালবোধনে মহালয়ার পরদিন হতে নবমী পর্যন্ত নবরাত্রিতে মায়ের এ নয়টি রূপের পূজা করা হয়।

শৈলপুত্রী

নবদূর্গার প্রথম রূপ শৈলপুত্রী। গিরি রাজ হিমালয়ের কন্যা বলে তিনি শৈলপুত্রী নামে খ্যাত। তিনি বৃষভ বাহনা, দ্বিভূজা, হস্তে ত্রিশূল আর পদ্ম ধারিনী। নবরাত্রী পূজায় মহালয়ার পর প্রতিপদের দিন মায়ের ধ্যান ও পূজা করা হয়।

ব্রহ্মচারিণী

এটি মায়ের দ্বিতীয় রূপ। মা এখানে নিজেই সাধিকা ব্রহ্মচারিণী রূপে প্রকাশিতা এবং এইরূপেও মা দ্বিভূজা। দুই হাতে মা অক্ষমালা এবং কমন্ডুলু ধারিনী। দ্বিতীয়াতে মায়ের ধ্যান ও পূজা করার নিয়ম। মা ভক্তকে বৈরাগ্য, সদাচার ও সংযম দান করেন।

চন্দ্রঘন্টা

এটি নবদূর্গার তৃতীয় রূপ। মা কল্যাণী রূপে আবির্ভূতা এবং তিনি তাঁর ভক্তদের কল্যাণ দান করেন। মায়ের দশ হাত এবং মা ব্যাঘ্রবাহনা। তৃতীয়াতে মায়ের বন্দনা ও পূজো করার নিয়ম।

কুষ্মাণ্ডা

মায়ের চতুর্থ রূপ কূষ্মান্ডা। মা অষ্টভূজা এবং বাঘের উপর সমাসীনা। চতুর্থীতে মায়ের আরাধনা ও পূজো করা হয়। মা তাঁর ভক্তদের ব্যাধি থেকে মুক্ত করে ইহলৌকিক ও পরলৌকিক সমৃদ্ধি প্রদান করেন।

স্কন্ধমাতা

নবদুর্গার পঞ্চম রূপ স্কন্ধমাতা। সেনাপতি কুমার কার্তিক বা স্কন্দ এর মাতা তিনি, তাই মা স্কন্দমাতা নামে খ্যাত। মা চতুর্ভূজা ও সিংহ বাহনা। কোলে কার্তিককে নিয়ে মাতা বিরাজমানা। পঞ্চমীতে মায়ের ধ্যান ও পূজো করার নিয়ম। মা ভক্ত বাঞ্ছাকল্পতরু।

কাত্যায়নী

ঋষি কাত্যায়ন এর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মা আদ্যাশক্তি তার ঘরে আসেন, তাই তাঁর নাম কাত্যায়িনী। মা সিংহবাহনা এবং দ্বিভূজা। মা ভক্তদের নিজ নিজ উপাস্য বা ইষ্ঠ পথে মতি প্রদান করেন। বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ মা কাত্যায়নীর ব্রত ও পূজো করেছিলেন এবং ব্রজের গোপীদের কাত্যায়নী পূজা করতে বলেছেন। নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে কাত্যায়নীর ধ্যান ও পূজা করা হয়।

কালরাত্রি

মায়ের সপ্তম রূপ এটি। মা ভয়ঙ্করী, অন্ধকার বর্ণা, চতুর্ভূজা ও গর্বভবাহনা। ভয়ঙ্করী অন্ধকার বর্ণা হলেও মা কখনও দুঃখ প্রদানকারী নন। তাই এইরূপেও তিনি সবার মঙ্গল করেন এবং কালরাত্রি মঙ্গলদায়িনী নামে খ্যাত হন। সপ্তমীতে মায়ের ধ্যান ও পূজা করা হয়।

মহাগৌরী

এটি মায়ের অষ্টম রূপ। মা গৌর বর্ণের, চতুর্ভূজা এবং বৃষভ বাহনা, অষ্টবর্ষা অভেদ গৌরী। তাই এখানে মাকে আট বছর বয়সী মানা হয়। ইনি অপ্রাপ্ত বয়স্কা বালিকা রূপী। এই রূপ থেকেই মহাঅষ্টমীতে কুমারী পূজার আবির্ভাব ও প্রচলন এসেছে। তাছাড়া চন্ডীতেও বলা হয়েছে, “স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলাজগৎসু” অর্থাৎ জগতের সকল স্ত্রী তোমার অংশ স্বরূপ। তাই অষ্টমীতে দেবীর সামনে কুমারী বালিকাকে বসিয়ে যথার্থ উপাচারে দেবী জ্ঞানে বন্দনা করা হয়।

সিদ্ধিদাত্রী

নবদূর্গার নবম রূপশক্তি সিদ্ধিদাত্রী নামে পরিচিত। মা চতুর্ভূজা ও পদ্মাসনে বিরাজমান। মাতা এইরূপে ভক্তদের সর্বপ্রকার সিদ্ধি দান করেন। দূর্গা পূজার নবমীতে মায়ের আরাধনা ও পূজো করা হয়।

অপরাজিতা

প্রতিপদ হইতে নবমী পর্যন্ত মায়ের অলৌকিক ও মঙ্গলদায়িক নয়টি রূপের অর্থাৎ নবদুর্গার পূজো শেষ করে, দশমীতে অপরাজিতা পূজো করে মায়ের পূজোর অবসান তথা বিসর্জন প্রক্রিয়া করা হয়। অপরাজিতা দুর্গার পূজা বিজয়া দশমীর দিন বিসর্জনান্তে কুলাচার অনুসারে হয়ে থাকে। এই দেবী সিংহবাহিনী ও ত্রিনয়না। তার চার হাতে থাকে পিনাক, বাণ, খর্গ ও খেটক। তার মাথায় জটাজুট ও অর্ধচন্দ্র; কোমরে বাসুকি নাগের কটিবন্ধ। দশমী পূজোর দেবীকে অপরাজিতা বলা হয় মা অজেয় বলে। বিসর্জন দেওয়া শুধুমাত্র মাতৃবন্দনার রীতির ইতি দেওয়া, কেননা মা সর্বদা সর্বত্রই বিরাজিত তাই তিনি অপরাজিতা।

মা দুর্গার অষ্টোত্তর শতনাম 

১) দুর্গা ২) দুঃখহরা ৩) কৃতান্তদলনী ৪) মহামায়া ৫) কালজয়া ৬) কাত্যায়নী ৭) উমা ৮) ভবেশঘরণী ৯) ত্রিদিব জননী ১০) করালিনী ১১) কপালমালিকে ১২) কালিকে ১৩) কীর্ত্তিবাসপ্রিয়া ১৪) মহোদরী ১৫) সুরেশ্বরী ১৬) শঙ্করী ১৭) ব্রহ্মান্ড জননী ১৮) শিবানী ১৯) সত্যসনাতনী ২০) ভবানী ২১) অন্নপূর্ণা ২২) মহেশ্বরী ২৩) জগততারিণী ২৪) ভগবতী ২৫) শিবদূতী ২৬) সর্ব্বাণী ২৭) ঈশানী ২৮) ইন্দ্রানী ২৯) ঈশ্বরী ৩০) গণেশজননী ৩১) উগ্রচন্ডা ৩২) অপরাজিতা ৩৩) ঊর্ব্বশী ৩৪) রাজরাজেশ্বরী ৩৫) ষোড়শী ৩৬) মাতঙ্গী ৩৭) বগলে ৩৮) কমলে ৩৯) গায়ত্রী ৪০) ভূবনেশ্বরী ৪১) সর্ব্ববিশ্বোদরী ৪২) শুভঙ্করী ৪৩) ক্ষেমঙ্করী ৪৪) ছিন্নমস্তে ৪৫) মহিষমর্দ্দিনী ৪৬) সুবদনী ৪৭) বিরিঞ্চি-নন্দিনী ৪৮) দিগম্বরের ঘরণী ৪৯) দিগম্বরী ৫০) শিবে ৫১) চন্ডি ৫২) এলোকেশী ৫৩) শারদা ৫৪) বরদা ৫৫) অন্নদা ৫৬) শ্যামা ৫৭) মৃগেশবাহিনী ৫৮) মহেশ ভাবিনী ৫৯) কামাক্ষা রুদ্রানী ৬০) হররাণী ৬১) শমনত্রাসিনী ৬২) অরিষ্টনাশিনী ৬৩) দাক্ষায়নী ৬৪) পার্ব্বতী ৬৫) শঙ্কর সুন্দরী ৬৬) শাকম্ভরী ৬৭) শিব-সহচরী ৬৮) মহোদরী ৬৯) হররমা ৭০) ত্রিতাপহারিণী ৭১) বিমলা ৭২) অভয়া ৭৩) ভবরাণী ৭৪) মনোহরা  ৭৫) ব্রহ্মাণী ৭৬) নিতম্বিনী ৭৭) স্তম্ভিনী ৭৮) নরধাত্রী ৭৯) অপর্ণা ৮০) অন্নদা ৮১) সর্ব্বসিদ্ধিদাত্রী ৮২) চামুন্ডে ৮৩) নৃমুন্ডমালিকে ৮৪) নারায়নী ৮৫) শিবদারা ৮৬) কান্তিকরী ৮৭) তারা ৮৮) প্রিয়ঙ্করী ৮৯) কপালিনী ৯০) মৃগাঙ্ক-আননী ৯১) ভীমে ৯২) নৃমুন্ডমালিনী ৯৩) গিরীন্দ্র নন্দিনী ৯৪) গিরীশ বন্দিনী ৯৫) গৌরী ৯৬) গো-গজ জননী ৯৭) গোপেশকুমারী ৯৮) গোবিন্দ ভগিনী ৯৯) যোগিনী ১০০) পরায়ণী ১০১) দক্ষযজ্ঞ বিনাশিনী ১০২) হরসিংহারূঢ়া ১০৩) মেনকা দুলালী ১০৪) ভদ্রকালী ১০৫) মহাকালী ১০৬) বৈষ্ণবী জম্ভিনী ১০৭) জয়া ১০৮) মন্মথমথিনী

দেবী দুর্গা সংশ্লিষ্ট কিছু মন্ত্র

গণেশমাতা দুর্গা যা শিবরূপা শিবপ্রিয়া।

নারায়ণি বিষ্ণুমায়া পূর্ণব্রহ্মস্বরূপিনী।।

(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান, প্রকৃতি খন্ড, ১/১৩)

সরলার্থঃ যিনি গনেশ মাতা দুর্গা তিনিই শিবরূপীনী শিবের প্রিয়া। আবার তিনিই নারায়ণি বিষ্ণুমায়া, পূর্ণ পরমব্রহ্ম স্বরূপিনী।


ওঁ ত্বং বৈষ্ণবী-শক্তিরনন্ত-বীর্য্যা

বিশ্বস্য বীজং পরমাসি মায়া।

সন্মোহিতং দেবি সমস্তমেতৎ

ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তিহেতুঃ।।

(হে দেবি) তুমি বিষ্ণুর শক্তি, অনন্ত বীর্যের অধিকারিণী। তুমি এ বিশ্বের বীজ অর্থাৎ সৃষ্টির কারণ। তুমি মহামায়া। তোমার মায়াতেই সকল মোহিত। তুমি প্রসন্না হলে পৃথিবীতে মুক্তির কারণ হয়।


ওঁ অক্ষস্রক্পরশুং গদেষুকুলিশং পদ্মং ধনুঃ কুন্ডিকাং

দন্ডং শক্তিম্ অসিঞ্চ চর্ম্ম জলজং ঘন্টাং সুরাভাজনম্।

শূলং পাশসুদর্শনে চ দধতীং হস্তৈঃ প্রসন্নাননাং

সেবে সৈরিভমর্দিনীমিহ মহালক্ষ্মীং সরোজস্থিতাম্।।

যিনি আঠারটি হাতে অক্ষমালা, কুঠার, গদা, বাণ, বজ্র, পদ্ম, ধনুক, কমন্ডলু, দন্ড, শক্তি, খড়্গ, ঢাল, শঙ্খ, ঘন্টা, মদ্যপাত্র, শূল, পাশ এবং সুদর্শন চক্র ধারণ করেন, আমি সেই প্রসন্নবদনা মহিষ-মর্দিনী পদ্মের উপর অবস্থিতা মহালক্ষ্মীর আরাধনা করিতেছি।


অহং ভবানয়ঞ্চৈব রুদ্রোহয়ং যো ভবিষ্যতি।

একং রূপং ন ভেদোহস্তি ভেদে চ বন্ধনং ভবেৎ।।

তথাপীহ মদীয়ং শিবরূপং সনাতনম্।

মূলভূতং সদা প্রোক্তং সত্যং জ্ঞানমনন্তকম্।।

       (..... জ্ঞানসংহিতা)

অর্থাৎ আমি, তুমি, এই ব্রহ্মা এবং রুদ্র নামে যিনি উৎপন্ন হবেন, এই সকলই এক। এদের মধ্যে কোনো ভেদ নাই, ভেদ থাকলে বন্ধন হত। তথাপি আমার শিবরূপ সনাতন এবং সকলের মূল স্বরূপ বলে কথিত হয়, যা সত্য জ্ঞান ও অনন্ত স্বরূপ। এজন্য ভগবান বিষ্ণু এবং তাঁর বিভিন্ন অবতারগণ সর্বদা শিব উপাসনাই করতেন। তাই শ্রী কৃষ্ণেরও আরাধ্য ছিলেন পরমেশ্বর শিব।

 

ওঁ কালীং রত্ননিবন্ধনুপুরলসৎপাদাম্বুজামিষ্টদাং

কাঞ্চীরত্নদুকূলহারললিতাং নীলাং ত্রিনেত্রোজ্জ্বলাম্।

শূলাদ্যস্ত্রসহস্রমন্ডিতভুজাম্ উদ্বক্ত্রপীনস্তনীম্

আবদ্ধামৃতরশ্মিরত্ন-মুকুটাং বন্দে মহেশপ্রিয়াম্।।

যিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই তিন হইতে অভিন্না, যাঁহার চরণকমল রত্নখচিত নুপুর দ্বারা শোভিত, যিনি কোমরের কাঞ্চী এবং রত্নময় বস্ত্র ও হার দ্বারা শোভাময়ী হইয়াছেন, শূল প্রভৃতি সহস্র অস্রেয়ী যাঁহার বাহুগুলিতে শোভা পাইতেছে, যাঁহার বদন উন্নত এবং স্তনযুগল স্ফীত, যিনি মস্তকে অমৃতরশ্মি-বিচ্ছুরণকারী রত্নমুকুট ধারণ করিয়াছেন, যিনি তিনটি নয়নদ্বারা উজ্জ্বলা, সেই নীলবর্ণবিশিষ্টা, অভীষ্ট-প্রদায়িনী, মহেশপ্রিয়া দেবী কালীকে আমি বন্দনা করি।

 

ওঁ খড়গং চক্রগদেষু-চাপ-পরিঘান্ শূলং ভূশুন্ডীং শিরঃ,

শঙ্খং সন্দধতীং করৈস্ত্রিনয়নাং সর্ব্বাঙ্গভূষাবৃতাম্।

যামস্তৌচ্ছয়িতে হরৌ কমলজো হন্তুং মধুং কৈটভম্

নীলাশ্মদ্যুতিমাস্য-পাদদশকাং সেবে মহাকালিকাম্।।

যিনি হাতে খড়্গ, চক্র, গদা, ধনুক, বাণ, পরিঘ (লগুড় বা লাঠি), শুল, ভূশুন্ডী নামক অস্ত্র, নরমুন্ড ও শঙ্খ ধারন করেন, যাঁহার চক্ষু তিনটি, যাঁহার সর্ব্বাঙ্গ ভূষণে (অলংঙ্কারে) শোভিত, যাঁহার শরীরের জ্যোতিঃ নীলকান্ত মণির মত, যাঁহার দশটি বদন ও দশটি চরণ, হরি যোগনিদ্রামগ্ন থাকার সময়ে মধু ও কৈটভ নামক দুই দৈত্যকে বিনাশ করিবার জন্য ব্রহ্মা যাঁহার স্তব করিয়াছিলেন, আমি সেই মহাকালীর সেবা বা উপসনা করিতেছি।

কোন মন্তব্য নেই

Akash Bairagi. Blogger দ্বারা পরিচালিত.