Header Ads

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মবিদ্যা

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মবিদ্যা 

ব্রহ্ম বা পরম ব্রহ্ম বা নির্গুণ ব্রহ্ম, এমন একটা স্বত্তা যা সমস্ত বর্ণনা ও ধারণার অতীত। শাস্ত্রে এটিকে নিরাকার হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা চিরকাল সবকিছুতে পরিবেষ্টিত, যা মহাবিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান এবং যা সবকিছুর বাইরে। পরম ব্রহ্ম সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা বিদ্যমান। অদ্বৈত বেদান্ত ঐতিহ্যে, পরমব্রহ্ম নির্গুণ ব্রহ্মের সমার্থক, অর্থাৎ গুণবিহীন পরম। বিপরীতভাবে, দ্বৈত বেদান্ত এবং বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত ঐতিহ্যে পরম ব্রহ্মকে সগুণ ব্রহ্ম হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, অর্থাৎ, গুণাবলীসহ পরম। বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্ম ও শাক্তধর্ম, যথাক্রমে বিষ্ণু, শিব এবং শক্তিকে পরম ব্রহ্ম হিসাবে বিবেচনা করে। গণপত্য সম্প্রদায় গনপতিকে এবং কার্তিকেয় সম্প্রদায় কার্তিককে পরম ব্রহ্ম হিসেবে বিবেচনা করে।

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মবিদ্যা

"পরা" একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ "সর্বতকৃষ্ট" অথবা "সর্বোচ্চ বা অখণ্ড"। ব্রহ্ম বলতে পরমকে বোঝায়, যা মহাবিশ্বের চূড়ান্ত বাস্তবতা। সনাতনী দর্শনে, এটি বিদ্যমান সবকিছুর উপাদান, দক্ষ, আনুষ্ঠানিক ও চূড়ান্ত কারণ। ব্রহ্ম- এর মূল ধারণা বেদ ও উপনিষদে পাওয়া যায়। অদ্বৈত বেদান্তসাহিত্যেও ব্রহ্ম ব্যাপক ভাবে আলোচিত।

অদ্বৈত বেদান্তে, পরম ব্রহ্মকে নির্গুণ ব্রহ্ম হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্রহ্মের সাথে অভিন্ন হিসাবে সম্পূর্ণ জ্ঞানের একটি অবস্থা, মানসিক-আধ্যাত্মিক জ্ঞান (জ্ঞান যোগ)। এটি সগুণ ব্রহ্মের সাথে বৈপরীত্য করে যা প্রেমময় সচেতনতার একটি অবস্থা (ভক্তি যোগ)। অদ্বৈত বেদান্ত দ্বৈতবাদীভাবে মনে করেন যে ব্রহ্ম ঐশ্বরিক, ঈশ্বর ব্রহ্ম এবং এটি আত্মার (নিজের আত্মা, অন্তর্নিহিত আত্মা) এবং নির্গুণ (গুণহীন), অসীম, প্রেম, সত্য, জ্ঞান, "সত্তা-চেতনা-আনন্দ" এর অনুরূপ। অথবা এভাবে বলা যায়, নির্গুণ ব্রহ্ম একটি "সত্তার অবস্থা", যেখানে নিজের আত্মা ও ব্রহ্মের মধ্যে দ্বৈতবাদী সমস্ত পার্থক্য মুছে ফেলা হয় এবং পরাস্ত হয়। বিপরীতে, সগুণ ব্রহ্ম, যেখানে নিজের আত্মা এবং ব্রহ্মের মধ্যে দ্বৈততা গ্রহণ করার পরে পার্থক্যগুলি মিলিত হয়। অদ্বৈত একটি অ-দ্বৈত অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে, যেখানে একটি বিষয়গত অভিজ্ঞতাও জ্ঞানের একটি "বস্তু" এবং একটি অভূতপূর্ব বাস্তবতা হয়ে ওঠে। পরম সত্য বিষয় ও বস্তু উভয়ই, তাই কোন গুণগত পার্থক্য নেই; পরম সত্যকে জানে এমন বিদ্যাশাস্ত্রবিদরা এই অ-দৈত সত্বাকে ব্রহ্ম, পরমাত্মা বা ভগবান বলেন (ভাগবত পুরাণ ১/২/১১)। যে ব্যক্তি পরম ব্রহ্মকে উপলব্ধি করে সে পরম সৌভাগ্য লাভ করে। সেই পরম ব্রহ্ম চিরন্তন সত্য (সত্যম), সর্বজ্ঞ (জ্ঞানম), অসীম (অনন্তম)।

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মবিদ্যা (পর্ব- ০১)

উপনিষদে বলা হয়েছে যে, পরম ব্রহ্ম চিরন্তন, চৈতন্যময় ও সুখী সৎ-চিত-আনন্দ। এই সত্যের উপলব্ধি এই সত্যের সমান হওয়া। পরম একজনই। যে পরিতোষের আঁধার ও পরমানন্দকে উপলব্ধি করে, সে চিরকাল আনন্দিত হয় (তৈত্তিরীয় উপনিষদ ২/৭/১-২)। প্রকৃতপক্ষে পরম জান, সুখী হও। (বৃহদারণ্যকোপনিষদ্‌ ২/৯/২৮)

উপনিষদে অব্যক্ত পরমেশ্বরের স্বরূপ কখন সগুণ, কখন সগুণ-নির্গুণ এইরূপ উভয়বিধ এবং কখন শুদ্ধ নির্গুণ, এই তিন প্ৰকার বর্ণিত হয়েছে দেখা যায়। উপাসনায় সর্বদা প্ৰত্যক্ষ মূর্তিই চোখের সম্মুখে থাকতে হবে এমন কোন কথা নাই। নিরাকার অর্থাৎ চক্ষুরাদি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অগোচর স্বরূপের উপাসনাও হতে পারে। কিন্তু যার উপাসনা করতে হবে তিনি চক্ষুরাদি জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের গোচর না হলেও, মনের গোচর না হলে তাঁর উপাসনা হতে পারে না। উপাসনা অর্থে চিন্তন, মনন বা ধ্যান। চিন্তিত বস্তুর কোন রূপ না থাকলেও অন্য কোনও গুণ মনের উপলব্ধি না হলে মন কিসের চিন্তা করবে? তাই উপনিষদে যে যে স্থানে অব্যক্ত অর্থাৎ চক্ষের অগ্রাহ্য পরমাত্মার উপাসনা (চিন্তন, মনন, ধ্যান) কথিত হয়েছে, সেই সেই স্থানে অব্যক্ত পরমেশ্বর সগুণ বলেই কল্পিত হয়েছেন। পরমাত্মা সম্বন্ধে কল্পিত এই গুণ উপাসকের অধিকার অনুসারে ন্যূনাধিক ব্যাপক বা সাত্ত্বিক হয়ে থাকে; এবং যার যেরূপ নিষ্ঠা তার সেরূপ ফলও লাভ হয়। ছান্দোগ্যোপনিষদে উক্ত হয়েছে, “পুরুষ ক্রতুময়, যার যেরূপ ক্রতু (নিশ্চয়), মরিবার পর সে সেরূপই ফল প্ৰাপ্ত হয়”, এবং ভগবদ্‌গীতাতেও কথিত হয়েছে যে, “দেবতাদের প্রতি ভক্তিমান দেবতাদের সহিত এবং পিতৃগণের প্রতি ভক্তিমান পিতৃগণের সহিত গিয়া মিলিত হয়” (গী. ৯/২৫)। অথবা “যো যচ্ছ্রদ্ধঃ স এব সঃ”- যার যেরূপ শ্ৰদ্ধা তার সেরূপ সিদ্ধি লাভ হয় (১৭|৩)। তাৎপর্য এই যে, উপাসকের অধিকারভেদে উপাস্য অব্যক্ত পরমাত্মার গুণও উপনিষদে ভিন্ন ভিন্নরূপে বর্ণিত হয়েছে। উপনিষদের এই প্রকরণকে ‘বিদ্যা’ বলে। বিদ্যা ঈশ্বর প্রাপ্তির (উপাসনারূপ) মাৰ্গ, এবং এই মাৰ্গ যে প্রকরণে কথিত হয়ে থাকে, তাহাও শেষে ‘বিদ্যা’ নামে অভিহিত হয়।

শাণ্ডিল্যবিদ্যা (ছাং|৩|১৪), পুরুষবিদ্যা (ছাং|৩|১৬,১৭), পর্যঙ্কবিদ্যা (কৌষী/১), প্রাণোপাসনা (কোষী/২) ইত্যাদি অনেক প্রকারের উপাসনা উপনিষদে বর্ণিত হয়েছে; এবং বেদান্তসূত্রের তৃতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় পাদে এই সকল বিষয়ের বিচার করা হয়েছে। এই প্রকরণে অব্যক্ত পরমাত্মার সগুণ বৰ্ণন এই প্রকারে করা হয়েছে যে তিনি মনোময়, প্ৰাণশরীর, ভাবরূপ, সত্যসঙ্কল্প, আকাশাত্মা, সর্বকর্মা, সর্বকাম, সর্বগন্ধ ও সর্বারস। তৈত্তিরীয়োপনিষদে তো অন্ন, প্ৰাণ, মন, জ্ঞান বা আনন্দ- এই সকল রূপেও পরমাত্মাৱ ক্ৰমোচ্চ উপাসনা কথিত হয়েছে (তৈ/২/১-৫; ৩/২-৬)। বৃহদারণ্যকে (২|১)।

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মবিদ্যা (পর্ব- ০২)

অজাতশত্রুকে গাৰ্গ্য বালাকী সর্বপ্রথম আদিত্য, চন্দ্ৰ, বিদ্যুৎ, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল বা দিক্‌সমূহে অধিষ্ঠিত পুরুষসমূহেরই ব্ৰহ্মরূপে উপাসনা কথিত হয়েছে; কিন্তু পরে প্রকৃত ব্ৰহ্ম এই সকলেরও অতীত, ইহা অজাতশত্রু তাহাকে বলে শেষে প্ৰাণোপাসনাকেই মুখ্য প্রতিপাদন করেছেন। এতেই এই পরম্পরা কিছু সম্পূর্ণ হয় না। উপরি-উক্ত সমস্ত ব্ৰহ্মরূপকে ‘প্রতীক’ অৰ্থাৎ এই সকলকে উপাসনার জন্য কল্পিত গৌণ ব্ৰহ্মস্বরূপ কিংবা ব্রহ্মনিদর্শক চিহ্ণ বলা যায়; এবং এই গৌণ রূপকেই কোন মূর্তির রূপে চোখের সামনে রাখিলে তাকেই ‘প্ৰতিমা’ বলা হয় । কিন্তু, সমস্ত উপনিষদের এই সিদ্ধান্ত যে, প্ৰকৃত ব্ৰহ্মস্বরূপ ইহা হতে ভিন্ন (কেন- ১/২-৮)। এই ব্ৰহ্মের লক্ষণ বৰ্ণনা করার সময় কোন স্থানে “সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্ৰহ্ম” (তৈত্তি-২|১) কিংবা “বিজ্ঞানমানন্দং ব্ৰহ্ম” (বৃ-৩/৯/২৮) বলা হয়েছে; অর্থাৎ ব্ৰহ্ম সত্য (সৎ), জ্ঞান (চিৎ) এবং আনন্দ রূপ অৰ্থাৎ সচ্চিদানন্দস্বরূপ,- এই প্রকারে তিনগুণেরই মধ্যে সমস্ত গুণের সমাবেশ করে বৰ্ণনা করা হয়েছে। অন্যস্থানে, ভগবদ্‌গীতারই ন্যায় পরস্পরবিরুদ্ধ গুণসমূহ একত্ৰ করে ব্ৰহ্মের বর্ণন এইপ্ৰকার করা হয়েছে যে, “ব্ৰহ্ম সৎও নহেন, অসৎও নহেন” (ঋ-১০/ ১৯০) অথবা “অণোরণীয়ান্‌ মহতো মহীয়ান্‌” অর্থাৎ অণু অপেক্ষা ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ অপেক্ষাও বৃহৎ (কঠ-২/ ২০), “তদেজতি তন্নৈজতি তদ্‌দূরে তদ্বন্তিকে” অর্থাৎ তিনি চলেন এবং চলেন না, তিনি দূরেও আছেন, এবং নিকটেও আছেন (ঈশ-৫; মুং-৩/১/৭), অথবা ‘সর্বেন্দ্ৰিয় গুণাভাস’ অথচ ‘সর্বেন্দ্ৰিয়বিবর্জিত’ (শ্বেতা-৩/ ১৭)। যম নচিকেতাকে এই জ্ঞানোপদেশ দিয়েছেন যে, শেষে উপযুক্ত সমস্ত লক্ষণ ছাড়িয়া দিয়া ধর্ম ও অধর্মের, কৃত ও অকৃতের, কিংবা ভূত ও ভব্যেরও অতীত যিনি তাকেই ব্ৰহ্ম বলে জান (কঠ-২/১৪)। এইপ্ৰকার মহাভারতের নারায়ণীয় ধর্মে ব্ৰহ্মারুদ্রকে (ম.ভা/শাং-৩৫১/১১), এবং মোক্ষধর্মে নারদ শুকদেবকে বলেছেন (৩৩১/৪৪)। বৃহদারণ্যক উপনিষদেও (২/৩/২) পৃথিবী, জল ও অগ্নি, এই তিনটীকে ব্ৰহ্মের মূর্তরূপ বলা হয়েছে; আবার বায়ু ও আকাশকে অমূর্তরূপ বলে দেখানো হয়েছে যে, এই অমূর্তের সারভূত পুরুষের রূপ বা রং বদল হয়; এবং শেষে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, ‘নেতি নেতি’ অর্থাৎ এতক্ষণ পর্যন্ত যা কিছু বলা হল, তা নহে, তা ব্ৰহ্ম নহে, - এই সমস্ত নামরূপাত্মক মূর্ত বা অমূর্ত পদার্থের অতীত (পর) যে ‘অগৃহ্য’ বা ‘অবৰ্ণনীয়’ আছেন তাকেই পরব্রহ্ম জানবে (বৃহ-২/৩/৬ এবং বেসূ-৩/২/২২)। যে যে পদার্থের কোন নাম দেওয়া যায় সেই সমস্তেরও অতীত যিনি, তিনিই পরব্ৰহ্ম এবং সেই ব্ৰহ্মের অব্যক্ত ও নির্গুণ স্বরূপ দেখাবার জন্য ‘নেতি নেতি’ এই এক ক্ষুদ্র নির্দেশ, আদেশ বা সূত্রই হয়ে গেছে এবং বৃহদারণ্যকোপনিষদেই এর চারবার প্রয়োগ হয়েছে (বৃহ-৩/৯/২৬; ৪/২/৪; ৪/৪/২২; ৪/৫/১৫)। সেরূপ অন্য উপনিষদেও পরব্রহ্মের নির্গুণ ও অচিন্ত্য রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়, যথা- “যতো বাচো নিবৰ্ত্তন্তে অপ্ৰাপ্য মনসা সহ” (তৈত্তি- ২/৯); “অদ্রেশ্যং (অদৃশ্য), অগ্ৰাহ্য” (মুং- ১/১/৬) “ন চক্ষুষা গৃহ্যতে নাপি বাচা” (মুং- ৩/১/৮)– চোখে দেখা যায় না কিংবা নাক্যের দ্বারা বলা যায় না; অথবা- অশব্দমস্পর্শম রূপমব্যয়ং তথাহরসং নিত্যমগন্ধবচ্চ যৎ৷ অনাদ্যনন্তং মহতঃ পরং ধ্রুবং নিচায্য তন্মত্যুমুখাৎ প্ৰমুচ্যতে॥ অর্থাৎ সেই পরব্রহ্ম পঞ্চ মহাভূতের শব্দ, স্পৰ্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এই পাঁচ গুণবিরহিত, অনাদি, অনন্ত, ও অব্যয় (কঠ/৩/১৫; বেসূ/৩/২/২২-৩০)। মহাভারতের শান্তিপর্বে নারায়ণীয় বা ভাগবত ধর্মের বর্ণনাতেও ভগবান নারদকে আপন বাস্তব স্বরূপ “অদৃশ্য, অঘ্রেয়, অস্পৃশ্য, নির্গুণ, নিষ্ফল (নিরবয়ব), অজ, নিত্য, শাশ্বত ও নিষ্ক্রিয়” এইরূপ বলিয়া তিনিই জগতের উৎপত্তি ও প্ৰলয়কর্তা ত্ৰিগুণাতীত পরমেশ্বর, এবং একেই ‘বাসুদেব পরমাত্মা’ বলা হয়, এইরূপ বলিয়াছেন (মভাশাং/৩৩৯/ ২১-২৮)।

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মবিদ্যা (পর্ব- ০৩)

উপনিষদের মূল আলোচ্য হল ব্রহ্মবিদ্যা ও আত্মবিদ্যা (আত্মন্‌ বা স্ব-সত্তাকে জানার বিদ্যা); এই দুই ধারণার সংজ্ঞা ও তৎসম্পর্কিত চর্চার প্রকৃতি। উপনিষদগুলি এই বিষয়ে কোনও একক ও সুসংহত তত্ত্বের অবতারণা করে না, বরং বহুভাবে অনুধাবন করার যোগ্য অনেকগুলি সম্ভাব্য দিকনির্দেশ দেয়, যেগুলি থেকে পরবর্তী বৈদিক যুগে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রীয় শাখার উদ্ভব হয়েছে। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের মতে, উপনিষদের ঋষিরা ব্রহ্মকে ব্যাখ্যা করেছেন চক্ষুকর্ণের অগোচর সেই সমস্ত ঘটনাবলীর পরম সার হিসেবে যাদের শুধুমাত্র আত্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমেই অনুধাবন করা সম্ভব। পল ডয়সনের মতে পরাবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা ও মুক্তিতত্ত্বের বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে উপনিষদে প্রাপ্ত ব্রহ্মের ধারণার ব্যাখ্যা করা যায়। এর সমর্থনে তিনি একাধিক উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন, যেমন "সৃষ্টিকে জন্মদান, রক্ষা ও লয়কারী আদিম সত্য", "সৃষ্টির নীতিস্বরূপ", "পরম সত্য", "সীমিত অথচ অসীম", "মহাজাগতিক নীতিস্বরূপ", "সমস্ত দেবতাসহ সমগ্র বিশ্বের পরম কারণ", "দৈব সত্তা, ঈশ্বর, পরমেশ্বর, বা আত্মস্থিত ঈশ্বর", "পরম জ্ঞানস্বরূপ", "সর্বমানবের অভ্যন্তরস্থ নির্ভীক, জ্যোতিস্বরূপ, শুদ্ধ ও মুক্ত আত্মজ্ঞান", "আধ্যাত্মিক মুক্তি ও স্বনির্ভরতার সার", "সর্বজীবের অন্তর্বিশ্ব ও বহির্বিশ্ব" "চরাচরের অন্তরে, বাইরে ও সর্বত্র বিরাজমান সবকিছুর সারবত্তা।" গেভিন ফ্লাড উপনিষদে বিবৃত ব্রহ্মের ধারণার সারসংক্ষেপ করে বলেছেন- "অনন্ত বিশ্ব ও মহাজগতের ক্ষুদ্রতম কণা তথা অন্তঃসার", "বোধগম্য কিন্তু অদৃশ্য সব কিছুর সার", "সর্বমানব ও সর্বজীবের আত্মা", "সত্য", "বাস্তব", "পরম" ও "আনন্দ"। ব্রহ্মের ধারণার ব্যাখ্যার্থে বিভিন্ন উপনিষদে একাধিক "মহাবাক্য" রয়েছে, যথা:-

·       অহং ব্রহ্ম অস্মি (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৪.১০) "আমি ব্রহ্ম"।

·       অয়ম্‌ আত্মা ব্রহ্ম (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪.৪.৫) "এই আত্মা ব্রহ্ম"।

·       সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.১) "এই সবকিছুই তো ব্রহ্ম"।

·       একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.২.১) "এক[ব্রহ্ম]-ই অদ্বিতীয়"।

·       তত্ত্বমসি (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.৪.৭) "তুমিই সেই" ("তুমিই ব্রহ্ম")।

·       প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম (ঐতরেয় উপনিষদ ৩.৩.৭) "জ্ঞান ব্রহ্ম"।

উপনিষদে ব্রহ্মের পরাবিদ্যাভিত্তিক বিস্তৃত আলোচনা আছে। অন্যতম প্রাচীনতম উপনিষদ ছান্দোগ্য উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের শাণ্ডিল্য সূত্র এই ক্ষেত্রে উল্লেখ্য। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা আছে আত্মনের অস্তিত্ব আছে, ব্রহ্ম ও আত্মন্‌ পরস্পর অভিন্ন, সুতরাং মানবের অন্তরেও ব্রহ্মের অধিষ্ঠান। এই উদ্ধৃতিগুলি ধর্মের বহু অর্বাচীন শাস্ত্র ও আধুনিক দর্শনের আলোচনায় বহুল ব্যবহৃত। এই চরাচর ব্রহ্ম। একে নিভৃতে তজ্জলন হসেবে অর্চনা করতে হয়। (যা থেকে উৎপত্তি, যা তার প্রাণ এবং যাতে তার লয়) (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.১)। মানব তার ক্রতুময়ের (ইচ্ছাশক্তি) জীব। অতঃপর এই ইচ্ছাশক্তিকে তার গোচরে আসতে দাও। যিনি জ্ঞানী, যাঁর শরীর জীবন-সূত্রের দ্বারা সম্পৃক্ত, যাঁর অবয়ব জ্যোতির্ময়, যাঁর চিন্তা সত্যচালিত, যাঁর আত্মা ব্যোম-সদৃশ (অদৃশ্য অথচ বর্তমান), যাঁর থেকে সর্বকর্ম, সর্ববাসনা, সর্ব ইন্দ্রিয় উৎপন্ন হয়ে চরাচরকে বেষ্টন করে রাখে, যিনি মৌন ও নির্বিকার, তিনিই আমি, আমার আত্মা, আমার অন্তরের সত্তা (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.১ থেকে ৩.১৪.৩)।

এই আমার অন্তরতম আত্মা, এই পৃথিবীর চেয়ে বড়, এই আকাশের চেয়ে বড়, এই ব্রহ্মাণ্ডের চেয়ে বড়। এই আত্মা, এই আত্মসত্তাই হল সেই ব্রহ্ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.৩ থেকে ৩.১৪.৪)। পল ডয়সন দেখিয়েছেন যে উপরে উদ্ধৃত আত্মা সম্পর্কিত মতবাদ বহু শতাব্দী পরে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে নব্য প্লেটোবাদী দার্শনিক প্লটিনাসের এনিয়াডেস গ্রন্থে পুনরাবৃত্ত হয়েছিল (এনিয়াডেস ৫.১.২)।

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মবিদ্যা (পর্ব- ০৪)

এতৎ জ্ঞেয়ং নিত্যমেব আত্মসংস্থং নাতঃ পরং বেদিতব্যং হি কিঞ্চিৎ।

ভোক্তা ভোগ্যং প্রেরিতারং চ মত্বা সর্বং প্রোক্তং ত্রিবিধং ব্রহ্মমেতৎ।। (শ্বেতাশ্বতর-১/১২)।

অর্থাৎ : ব্রহ্ম যে অন্তরতম সত্তা, সর্বদা তিনি যে ভেতরে রয়েছেন, এ সত্য জানতে হবে। এর চেয়ে উচ্চতর আর কোন জ্ঞান নেই। জীব (ভোক্তা), জগৎ (ভোগ্য), এবং অন্তর্যামী ঈশ্বর (প্রেরিতারম্)- এই তিনই যে ব্রহ্ম একথাটা জানতে হবে। ব্রহ্মের এই স্বরূপ জানতে গিয়ে উপনিষদের বিভিন্ন ঋষিগণ ব্রহ্মকে সৎ, উদ্গীথ, প্রাণ, ভূমা, পুরুষ, দহর, বৈশ্বানর, আনন্দময়, অক্ষর, মধু প্রভৃতি বিভিন্ন নামে বর্ণনা করে জ্ঞান দ্বারা উপাসনার কথা বলেছেন। এ সকল নামকে কেন্দ্র করে এই বিষয়ে কৃত উপদেশসমূহের নাম হয়েছে সৎ-বিদ্যা, উদ্গীথ-বিদ্যা, প্রাণবিদ্যা, ভূমা-বিদ্যা ইত্যাদি। এই বিদ্যা দ্বারাই মোক্ষ তথা পুরুষার্থ প্রাপ্ত হয় বলে বাদরায়ণ মনে করেছেন। তাই বেদান্তসূত্রে তিনি বলেন-

·       ‘সর্ববেদান্তপ্রত্যয়ম্, চোদনাদ্যবিশেষাৎ’ (ব্রহ্মসূত্র-৩/৩/১)।

অর্থাৎ, ভিন্ন ভিন্ন বেদান্ত গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্নরূপ উপাসনা উপদিষ্ট হলেও উপাস্য বিষয় একই (ব্রহ্ম) এবং ফল (ব্রহ্ম-উপলব্ধি) বিষয়েও এদের মধ্যে পার্থক্য নেই।

·       ‘ভেদান্নেতি চেৎ, ন একস্যামপি’ (ব্রহ্মসূত্র-৩/৩/২)।

অর্থাৎ, উপাসনার প্রকার ভেদ আছে- অতএব সর্ব বেদান্তবর্ণিত উপাসনা এক নয়- এরূপ বলা সঙ্গত হবে না- কারণ, উপাসনা এক হলেও তার প্রকার ভেদ থাকতে পারে।

·       ‘দর্শয়তি চ’ (ব্রহ্মসূত্র-৩/৩/৪)।

অর্থাৎ, সকল শ্রুতিও উপাসনার এই একত্বের কথাই বলেছেন।

যেমন বৃহদারণ্যক উপনিষদে মর্ত থেকে স্বর্গ পর্যন্ত বিস্তারিত বলে বর্ণিত যে বৈশ্বানররূপী সগুণ ব্রহ্মের উপাসনার কথা আছে তা-ই ছান্দোগ্য উপনিষদে উল্লেখ করে বলা হয়েছে-

·       আপয়িতা হ বৈ কামানাং ভবতি য এতৎ এবম্ বিদ্বান্ অক্ষরম্ উদ্গীথম্ উপাস্তে’। (ছান্দোগ্য-১/১/৭)।

অর্থাৎ : ‘ওম্’ই সবকিছুর আশ্রয়- এইভাবে যিনি অক্ষর ‘ওম্’কে উদ্গীথরূপে (ব্রহ্মরূপে) উপাসনা করেন, তিনি যা যা পেতে চান (পরিণামে) তাই লাভ করেন।

তাই কঠ-উপনিষদেও বলা হয়েছে-

·       সর্বে বেদা যৎ পদম্ আমনন্তি তপাংসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি।

যৎ ইচ্ছন্তঃ ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তৎ তে পদং সংগ্রহেণ ব্রবীমি- ওম্ ইত্যেতৎ। (কঠোপনিষদ-১/২/১৫)।

অর্থাৎ : সকল বেদসমূহ একবাক্যে যে ঈপ্সিত বস্তুর প্রতিপাদন করেন, যাঁকে পাবার জন্য সবরকমের তপস্যা, ব্রহ্মচর্যের সাধনা, তিনিই হলেন পরমাত্মা ব্রহ্ম- সংক্ষেপে ‘ওম্’।

কোন মন্তব্য নেই

Akash Bairagi. Blogger দ্বারা পরিচালিত.